রূপে-গুণে খেজুর – The Finance BD
 ঢাকা     রবিবার, ২৪ অগাস্ট ২০২৫, ০২:০৪ অপরাহ্ন

রূপে-গুণে খেজুর

  • ১৭/০৩/২০২৪

ইসলাম ধর্মে খেজুরকে অন্যান্য সব ফল থেকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। কোরআন শরিফে খেজুরের কথা বলা হয়েছে। সুরা মরিয়মে এর উপকারিতার কথাও বর্ণনা করা হয়েছে। খেজুর এক ধরনের তালজাতীয় শাখাবিহীন বৃক্ষ। এর বৈজ্ঞানিক নাম ফিনিক্স ড্যাকটিলিফেরা। এ গাছটি প্রধানত মরু এলাকায় ভালো জন্মে। এই ফলটি অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণে ভরপুর বলে বেশিরভাগ মানুষ এটি খেতে পছন্দ করেন। শুধু পুষ্টিগুণ কেন, অসাধারণ ঔষধি গুণসম্পন্নও এই ফলটি। বিস্তারিত লিখেছেন লায়লা আরজুমান্দ

ইতিহাস

খেজুরকে আরবিতে ‘তুমুর বা তামুর বা তামারুন’ বলে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে সুমিষ্ট ও পুষ্টিকর ফল হিসেবে চিহ্নিত করা হয় একে। খেজুরের চাষ ঠিক কবে শুরু হয়েছিল বা ঠিক কোনো জায়গায় এর প্রথম চাষ হয়, সেই বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সেই বিষয়ে নানা জনের নানা মত রয়েছে। আরবের পূর্বাঞ্চলে খৃস্টপূর্ব ৫৫৩০ থেকে ৫৩২০ পর্যন্ত খেজুর চাষের প্রতত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ রয়েছে। বর্তমান ইরাকের আশপাশে এর চাষ শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়। পরে প্রাচীনকালে মেসোপটেমিয়া থেকে প্রাগৈতিহাসিক মিসর পর্যন্ত এর চাষাবাদ চলে। প্রাগৈতিহাসিক মিসরীয়রা খেজুর থেকে মদ তৈরি করত। আরও পরে এসে বণিকদের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনে খেজুরের প্রচলন হয়।

খেজুরের পুষ্টিগুণ

অনেকেই মনে করেন শুকনো খেজুর থেকে ফ্রেশ ফলে বেশি পরিমাণ পুষ্টি থাকে। তবে এটা একদমই ভুল ধারণা। বরং শুকনো খেজুরে আরও বেশি পরিমাণে ক্যালোরি থাকে। খেজুরের বেশির ভাগ ক্যালোরিই আসে কার্বোহাইড্রেট থেকে। প্রতি ১০০ গ্রাম খেজুরে রয়েছে ক্যালোরি ২৭৭, কার্বোহাইড্রেট ৭৫ গ্রাম, ফাইবার বা আঁশ ৭ গ্রাম, প্রোটিন ২ গ্রাম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, ভিটামিন বি-৬সহ অন্যান্য পুষ্টি উপাদান। তা ছাড়া খেজুরে আছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট যা কিনা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

উপকারিতা

পুষ্টিকর এই ফলকে প্রাকৃতিক শক্তির উৎসও বলা হয়ে থাকে। কারণ কয়েকটি ফল খেলে যে পরিমাণ এনার্জি পাওয়া যায় তা অন্য কোনো ফল থেকে পাওয়া যায় না। অসাধারণ পুষ্টিগুণে ভরপুর শারীরিক সমস্যা দূর করতে অনেক কার্যকর।

রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায় : শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে ও সুস্বাস্থ্যের জন্য খুব দরকারি অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। অ্যান্টি অক্সিডেন্ট তারুণ্য ধরে রাখে, ক্লান্তি দূর করে, স্মৃতিশক্তি ভালো রাখতে, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ প্রতিহত করতে সাহায্য করে।

মস্তিষ্ক সচল রাখে : খেজুরের সবচেয়ে বড় গুণ হলো খেজুর মস্তিষ্ককে সচল ও প্রাণবন্ত রাখে। স্মৃতিশক্তি বাড়ায়। সেই সঙ্গে মস্তিষ্কের ক্ষমতাও বাড়ায়। বিশেষ করে বয়স্কদের জন্য খুবই উপকারী এটি।

পরিপাকে সাহায্য করে : খেজুরে রয়েছে এমন পুষ্টি উপাদান যা খাদ্য পরিপাকে সাহায্য করে। তা ছাড়া এতে থাকা ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্য রোধে সহায়তা করে। কখনো কখনো ডায়রিয়ার জন্যও এটা অনেক উপকারী।

ক্যানসার প্রতিরোধ : গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত খেজুর খেলে পেটের ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকটাই কমে আসে। এ ছাড়া যকৃতের সংক্রমণেও খেজুর উপকারী।

ওজন কমায় : যেহেতু খেজুর খেলে দীর্ঘ সময় আর ক্ষুধা লাগে না, তাই খাওয়াও হয় কম। তবে খাওয়া কম হলেও পুষ্টির ঘাটতি কিন্তু হয় না। কারণ মাত্র কয়েকটি খেজুর শরীরের প্রয়োজনীয় শর্করার ঘাটতি পূরণ করে দেয়।

হাড় মজবুত হয় : খেজুরে রয়েছে প্রচুর ক্যালসিয়াম, যা কিনা হাড় গঠনে সহায়ক। ফলে খেজুর হাড় মজবুত, শিশুদের দাঁতের মাড়ি শক্ত করতেও সাহায্য করে।

গর্ভাবস্থায় দরকারি : গর্ভাবস্থায় খেজুর খাওয়া খুবই উপকারী। নিজের ও অনাগত সন্তানের পুষ্টির বিষয়টি এ সময় খুবই দরকারি। এটা দুর্বলতা কাটাতে সাহায্য করে। এগুলো ছাড়াও খেজুরের রয়েছে আরও অনেক উপকারিতা। যেমন, হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে, যৌনক্ষমতা বাড়াতে, উচ্চ রক্তচাপ কমাতে, মায়ের বুকের দুধ বাড়াতেও খেজুর খাওয়া হয়।

বিভিন্ন রকমের খেজুর

সারা বিশ্বে কত রকমের খেজুর রয়েছে জানলে অবাক হবেন! ভাবতে পারেন সারা বিশ্বে রয়েছে অন্তত তিন হাজারেরও বেশি জাতের খেজুর। তাদের আকার, ধরন, রং, গন্ধ, পুষ্টিগুণও বিভিন্ন ধরনের হয়।

সৌদি আরবে ৪০০ রকমের, ইরানে ৪০০ রকমের, ইরাকে ৩৭০ রকমের, তিউনিশিয়ায় ২৫০ রকমের, ওমানে ২৫০ রকমের ও মরক্কোতে ২৪৪ রকমের খেজুর পাওয়া যায়।

জনপ্রিয় যেসব খেজুর রয়েছে তা হলো আজওয়া, মরিয়ম, আম্বার, আনবারা, ডিগ্রেট নূর, বারহি, ডেইরি, ডেগলেট, ইত্তিমা, কালমি, কুদরি, মাবরুম, মাকতুুম, মেডজল, সাফাওয়ি, সাগি, মুসকানি, ওয়ান্নাহ ইত্যাদি।

কোথায় বেশি উৎপাদন হয়

বিভিন্ন দেশে খেজুর বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়ে থাকে। সেসব আবার বিশ্বব্যাপী রপ্তানিও করা হয়। ২০১৭ সালে খেজুর উৎপাদনে সবচেয়ে এগিয়ে আছে মিসর। প্রতিবছর এই দেশে উৎপাদন হয় অন্তত ১০ লাখ ৮৪ হাজার মেট্রিক টন খেজুর। এদের বেশির ভাগ খেজুর রপ্তানি হয় মরক্কো, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায়। মিসরের পরেই রয়েছে ইরানের নাম। এই দেশে প্রতিবছর উৎপাদন হয় অন্তত ৯ লাখ ৪৭ হাজার মেট্রিক টন খেজুর। যার বেশির ভাগ রপ্তানি হয় এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। যেমন ভারত ও মালয়েশিয়া। খেজুর উৎপাদনে এর পর রয়েছে সৌদি আরবের নাম। বার্ষিক এই দেশে উৎপাদন হয় আট লক্ষ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন খেজুর। এই দেশের বেশির ভাগ খেজুর রপ্তানি হয় মূলত জর্ডান, ইয়েমেন ও কুয়েতে। এ ছাড়া ইরাকে ছয় লাখ ৭৫ হাজার, পাকিস্তানে পাঁচ লাখ ৫৬ হাজার, আলজেরিয়ায় চার লাখ ৮৫ হাজার, সুদানে চার লাখ ৩৫ মেট্রিক টন খেজুর উৎপাদন হয় প্রতিবছর।

রমজানে বেশি বিক্রি হয়

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও খেজুর খুবই জনপ্রিয়। সারা বছর বেচা-কেনা চললেও সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে পবিত্র রমজান মাসে। সারা দিন রোজা রেখে মানুষ সন্ধ্যায় বসে ইফতার গ্রহণ করে। খেজুর ছাড়া ইফতার যেন সম্পূর্ণ হয় না কারও। খেজুর দিয়েই রোজা ভাঙেন অনেকেই। উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সব ধরনের মানুষের কাছেই খেজুরের চাহিদা বেড়ে যায় রোজার সময়টাতে। সেই সময়টাতে আমাদের দেশের বাজারেও বেড়ে যায় খেজুরের দাম। বোখারি ও মুসলিম শরিফের হাদিস অনুযায়ী, রাসুল (সা.) ইফতার করতেন খেজুর ও পানি দিয়ে। ভেজা বা নরম খেজুর না থাকলে শুকনো খেজুর দিয়েই ইফতার করতেন।

আমাদের দেশের মধুবৃক্ষ

আরব দেশগুলোর মরুভূমি এলাকায় যেখানে অন্য কোনো গাছপালা জন্মানো সহজ হয় না, সেখানে খেজুরবাগান সৃষ্টি করে মরূদ্যান সৃষ্টি করা হতো। আমাদের দেশে মরুভূমি নেই। সবখানেই গাছপালা জন্মায়। খেজুরগাছও জন্মায় প্রচুর। খেজুরকে বলা হয়ে থাকে মধুবৃক্ষ। রাস্তা, বাঁধ, পুকুরপাড়, ক্ষেতের আইল এবং আবাদি জমিতে এ বৃক্ষ জন্মাতে দেখা যায় বেশি। আমাদের দেশে খেজুরগাছ বেশি দেখা যায় বৃহত্তর যশোর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও নাটোর অঞ্চলে। খেজুরের পাশাপাশি এই গাছের রস আমাদের দেশে খুবই জনপ্রিয়। শীতের ভোরে ঠান্ডা ঠান্ডা এক গ্লাস টাটকা খেজুরের রস খেতে পছন্দ করি অনেকেই। তা ছাড়া রস জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় পাটালি গুড়। শীতের মৌসুমে গুড় তৈরি বেশ জনপ্রিয় একটি পেশা। নানা রকমের পিঠা, পায়েসের স্বাদ বেড়ে যায় এই রস ও গুড় দিয়ে তৈরির কারণে। আমাদের দেশের সংস্কৃতিতে এই রস ও রসের পিঠা, পায়েস অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।

ক্যাটাগরিঃ লাইফস্টাইল

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

One Response to “রূপে-গুণে খেজুর”

  1. ২৯/০৪/২০২৪ at ১৩:০৭

    right

Leave a Reply to newsAdmin




Contact Us