কভিড-১৯ মহামারীর ধাক্কা সামলিয়ে উঠতে না উঠতে আবারো চাপের মুখে পড়েছে আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যবস্থা। মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত, মধ্য আফ্রিকার খরা ও যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলীয় বন্দরগুলোয় সদ্য প্রত্যাহার হওয়া ধর্মঘটের প্রভাবে বৈশ্বিক পণ্য পরিবহনে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে। পণ্য আনা-নেয়ায় বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে আমদানি-রফতানিকারকদের। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাপী সবরবরাহ সংকোচনসহ মূল্যস্ফীতি বাড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এক বছর ধরে পণ্য পরিবহনে ক্রমবর্ধমান হারে সমস্যার মুখে পড়ছেন আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীরা। মধ্যপ্রাচ্য উত্তেজনার জেরে গত বছর লোহিত সাগরের প্রধান বাণিজ্যিক রুটে হুথি বিদ্রোহীরা হামলা করে বসে। এ ধরনের হামলা এখনো অব্যাহত আছে। ফলে পণ্যবাহী জাহাজগুলো সুয়েজ খাল এড়িয়ে আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে উত্তমাশা অন্তরীপ দিয়ে চলতে বাধ্য হচ্ছে। এতে পরিবহন ব্যয় আকাশচুম্বী হয়েছে। আক্রমণের আগে লোহিত সাগর দিয়ে বিশ্বব্যাপী মোট পণ্য পরিবহনের ১২ শতাংশ সংঘটিত হতো। নিরাপত্তা শঙ্কায় প্রধান শিপিং প্রতিষ্ঠান মায়েরস্কসহ অনেক কোম্পানি এ রুট এড়িয়ে চলছে। উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে যাতায়াতে অতিরিক্ত ১০ দিন লাগে, যা সময় ও ব্যয় উভয়ই বাড়িয়ে দিচ্ছে।
সম্প্রতি নতুন করে লেবানন, ইরান ও ইসরায়েলের সংঘাত শুরু হয়েছে। এতে আরো অনেক কোম্পানি পথটি এড়িয়ে চলতে শুরু করতে পারে।
তবে শিপিং বিশ্লেষণ প্রতিষ্ঠান জেনেটার প্রধান বিশ্লেষক পিটার স্যান্ড বলেন, সাম্প্রতিক সংঘাতে নতুন করে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। কেননা ইতিমধ্যে অধিকাংশ জাহাজ পথটি এড়িয়ে চলছে।’ তবে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, সংঘাত আরো বাড়লে জাহাজগুলোকে এ রুটে ফেরত আনা কঠিন হয়ে পড়বে।
পানামা খাল দিয়ে চলাচল করা জাহাজের সংখ্যাও কমেছে। মধ্য আফ্রিকায় খরার কারণে এ বছরের শুরুতে দৈনিক জাহাজ চলাচলের সংখ্যা ৩৬ থেকে ২০-এ নামিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিল কর্তৃপক্ষ।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলীয় বন্দরের শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে বাণিজ্য বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা আরো বেড়েছে। গত মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল লংশোরম্যান অ্যাসোসিয়েশনের প্রায় ৫০ হাজার সদস্য অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট করেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলের ১৪টি বন্দরে প্রভাব ফেলে।
যুক্তরাজ্যের চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডের (সিআইইআইটি) ডিরেক্টর জেনারেল মারকো ফোরজিওন বলেন, ‘এসব সমস্যার কারণে”অত্যন্ত ভঙ্গুর সরবরাহ ব্যবস্থাগুলো ‘ব্যতিক্রমী চাপে’র সম্মুখীন হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য বিরোধ, এমনকি বাল্টিমোর ব্রিজ ধসের মতো ঘটনাও সরবরাহ ব্যবস্থায় চাপ বাড়িয়েছে।’
উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে চলাচলকারী মালবাহী কোম্পানিগুলোকে জ্বালানির জন্য ৪০ শতাংশ বাড়তি ব্যয় বহন করতে হচ্ছে। কনটেইইনারের মূল্যও বেড়েছে।
জেনেটার তথ্যানুযায়ী, গত জুলাইয়ে পূর্ব এশিয়া এবং উত্তর ইউরোপের মধ্যে চলাচলকারী ৪০ ফুট কনটেইনারের দাম ছিল ৮ হাজার ৫৮৭ ডলার, যা ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ৪৬৮ শতাংশ বেশি। প্রসঙ্গত সে সময় লোহিত সাগরে হুথি বিদ্রোহীদের হামলা বাড়ছিল।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরের ধর্মঘটের কারণে এরই মধ্যে উত্তর ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলেও কনটেইনারের দাম বেড়েছে। গত মঙ্গলবার ৪০ ফুট কনটেইনারের গড় মূল্য ছিল ২ ডলার ৮৬১ ডলার, যা আগস্টের শেষের দিকে ছিল ১ হাজার ৮৩৬ ডলার। মূলত পণ্য ভেলিভারির সময় বেড়ে যাওয়া কনটেইনারের দাম বাড়ার প্রধান কারণ।
চলতি বছরের শুরুতে পণ্য উৎপাদক এবং খুচরা বিক্রেতারা জানিয়েছিলেন, লোহিত সাগর এড়াতে আফ্রিকার চারপাশে ঘুরতে গিয়ে ডেলিভারির সময়ের সঙ্গে চার সপ্তাহ বাড়তি যোগ হচ্ছে। ফলে পর্যাপ্ত যন্ত্রাংশ সরবরাহের অভাবে ভলভো ও টেসলার মতো গাড়ি প্রস্তুতকারকদের উৎপাদন স্থগিত করতে হয়েছে। যুক্তরাজ্যের খুচরা বিক্রেতা ডিএফএস এবং জেডি স্পোর্টস বলছে, লোহিত সাগর সংকট তাদের বিক্রয়কে প্রভাবিত করেছে।
সিআইইআইটির ডিরেক্টর জেনারেল মারকো ফোরজিওন বলেন, ‘চলমান সংকট শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপর প্রভাব ফেলবে। সরবরাহ ব্যবস্থায় অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তার কারণে পণ্যের দাম বাড়তে পারে। এছাড়া একই মূল্যে আগের তুলনায় কম পণ্য কিনতে হতে পারে। এছাড়া কিছু পণ্যের সংকট তৈরি হতে পারে।’
এদিকে জ্বালানি তেলের দাম গত বুধবার দ্বিতীয় দিনের মতো বাড়তে বাড়তে প্রায় ৭৬ ডলার প্রতি ব্যারেলে পৌঁছে, যা সপ্তাহের শুরুতে ছিল ৭১ ডলার। কিছু বিশ্লেষক বলছেন, এটি কয়েক দিনের মধ্যে ৮০ ডলার অতিক্রম করতে পারে।
এদিকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে ইরানের জ্বালানি তেল অবকাঠামোগুলোয় হামলা চালানোর ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল। এতে বিশ্ববাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। গোল্ডম্যান স্যাকসের পূর্বাভাস, ইরান দৈনিক ১০ লাখ ব্যারেল জ্বালানি তেল উৎপাদন করতে পারে। তবে লোহিত সাগর রুটে সমস্যা হলে সরবরাহে আরো বিঘ্ন ঘটতে পারে। এতে পুরো মধ্যপ্রাচ্য থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল রফতানিতে প্রভাব ফেলবে।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়ার ঝুঁকি রয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে ১০ শতাংশে ওপরে চলে গিয়েছিল। এ সময় খাদ্য থেকে শুরু করে গৃহস্থালি জ্বালানির বিল, সব কিছুর দাম বেড়ে যায়। (খবরঃ গার্ডিয়ান)
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন