গত বছর হামাস বাহিনী যখন ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে, তখন দেশটির উত্তরাঞ্চলে শেলি লোটানের খাদ্যবিষয়ক স্টার্টআপ কোম্পানির যাত্রা কেবল শুরু হয়েছে। হামলা শুরু হলে ইসরায়েল সরকার ওই অঞ্চল থেকে সব নাগরিককে সরিয়ে নেয়।
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইসরায়েল সরকার শেলি লোটানের দুই কর্মচারীকে সামরিক বাহিনীতে নিয়ে যায়। যে কর্মচারীদের ডাকা হয়নি, তাঁরা আরেক কর্মচারীর বাবা-মায়ের বাসার ভূগর্ভস্থ কক্ষে সেই স্টার্টআপের কার্যালয় সরিয়ে নেন। এরপর যা হওয়ার তা–ই হয়; বিনিয়োগের প্রবাহ একরকম শুকিয়ে যায়।
হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হবে শিগগিরই। হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ বিরতির লক্ষণ নেই বললেই চলে; এর মধ্যে শুরু হয়েছে লেবাননে হিজবুল্লাহ বাহিনীর ওপর হামলা। এই পরিস্থিতিতে লোটানের ব্যবসা কোনোভাবে টিকে আছে। সরকারের ওপর ক্ষোভ বাড়ছে লোটানের। সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক চাপও বাড়ছে।
গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাস বাহিনী ইসরায়েলে হামলা চালালে চলতি যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। ইসরায়েলের অর্থনীতিতে এই যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে খুব একটা আলোচনা হচ্ছে না। এই এক বছরের মধ্যে ইসরায়েলের ঋণমান অবনমন হয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) সংকুচিত হয়েছে। হাজার হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক মানুষের চাকরি গেছে; কোম্পানিগুলো দূরবর্তী জায়গা থেকে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। সেই সঙ্গে রিজার্ভ সেনা হিসেবে যাঁরা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন, তাঁরা সৈনিক জীবনের সঙ্গে মূল ক্যারিয়ারের ভারসাম্য আনতে হিমশিম খাচ্ছেন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর ২ লাখ ৮৭ হাজার নাগরিক রিজার্ভ সেনা হিসেবে যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। ইসরায়েলের জনসংখ্যা এক কোটির কম। অর্থাৎ দেশটির এক-চতুর্থাংশের বেশি মানুষ যুদ্ধক্ষেত্রে আছেন। এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতি কীভাবে চলছে, তা বড় প্রশ্ন।
ইসরায়েলের অর্থনীতির বিশেষ দিক হলো তার বিশাল উচ্চ প্রযুক্তি খাত। এই খাতে যুদ্ধের তেমন প্রভাব না পড়লেও নির্মাণ ও কৃষি খাতে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। এই দুটি খাত আবার অনুমতি নিয়ে ইসরায়েলের কাজ করতে আসা ফিলিস্তিনিদের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। গত বছরের ৭ অক্টোবরের পর এদের কাজের অনুমতি বাতিল করা হয়েছে। ফলে এই দুটি খাতে যুদ্ধের প্রভাব বেশ ভালোভাবেই অনুভূত হচ্ছে।
পর্যটন খাতের অবস্থা শোচনীয়। এই খাতের ব্যবসা কমেছে ৭৫ শতাংশের বেশি। জেরুজালেমের পুরোনো শহর এমনিতে পর্যটকে গিজগিজ করলেও সেই এলাকার অনেক দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেছে।
জেরুজালেমের পুরোনো শহরে আয়মান শাওয়ারের পারিবারিক বেকারির ব্যবসা ৭ অক্টোবরের পর উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। আইসক্রিম বিক্রেতা আব্দুল কাদের আলামির ব্যবসাও শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।
যুদ্ধের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এই এক বছরে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যয় অন্তত দ্বিগুণ হয়েছে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্ক বার্তা, ২০২৫ সালের মধ্যে ইসরায়েলের যুদ্ধজনিত ক্ষতি ৬৭ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ৭০০ কোটি ডলারে উন্নীত হতে পারে। লেবাননে ইসরায়েলের চলমান হামলার আগেই এই পূর্বাভাস দিয়েছিল ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে বাস্তব ক্ষতি এর চেয়ে অনেক বেশি হবে। পর্যটনের ওপর অতি নির্ভরশীল পুরোনো জেরুজালেমের অর্থনীতি রীতিমতো ধসে পড়েছে। সেখানে অনেক ফিলিস্তিনির ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। নিকট ভবিষ্যতে তাঁরা যে পুনরায় ব্যবসা চালু করবেন, তেমন সম্ভাবনাও নেই।
ইসরায়েলের গবেষণা প্রতিষ্ঠান শোরেশ ইনস্টিটিউশন ফর সোশিওইকোনমিক রিসার্চের প্রধান ড্যান বেন ডেভিড ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, ইসরায়েলের অর্থনীতি বড় ধরনের বিপদে আছে; সরকারকে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এখন সরকারের সব মনোযোগ যুদ্ধ নিয়ে। এর অবসানের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
শেলি লোটান নিজের ব্যবসা পরিচালনার পাশাপাশি তিন সন্তানের লালন-পালন করেন। তাঁর স্বামী পাঁচ মাস ধরে সামরিক বাহিনীর রিজার্ভ সেনা হিসেবে যুদ্ধ করছেন। ইসরায়েলের বর্তমান পরিস্থিতিতে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানিগুলো স্টার্টআপে বিনিয়োগ করছে না। ফলে কোম্পানি পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। কার্যালয় পরিবর্তন করতে গিয়ে যে ব্যয় তাঁর হয়েছে, তা সামলাতে তিনি রীতিমতো গলদঘর্ম হচ্ছেন। সেই সঙ্গে তাঁর জীবনযাত্রার ব্যয়ও কেবল বাড়ছে।
সম্প্রতি আরেক স্টার্টআপ কোম্পানির স্বত্বাধিকারীর সঙ্গে কফি পান করতে করতে তাঁরা ঠিক করেছেন, এখন সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হলো, ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়া। শেলি লোটান বলেন, ‘আমাদের এখন মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু না ঘটলে অর্থনীতি শিগগিরই ধসে পড়তে পারে।’
তবে ইসরায়েল অর্থনীতি নিয়ে শঙ্কা যে কেবল গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে, তা নয়। তার আগেই দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সুপ্রিম কোর্টকে দুর্বল করার উদ্যোগ নিলে বিক্ষোভ শুরু হয়। তখন দেশটির গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়। বিনিয়োগকারীদের মনেও শঙ্কা তৈরি হয়।
ইসরায়েলের অর্থনীতি এমনিতে যথেষ্ট শক্তিশালী। মূলত প্রযুক্তি ও গবেষণা খাতের বড় কেন্দ্র হিসেবে সে দেশে বিপুলসংখ্যক স্টার্টআপ কোম্পানির কার্যক্রম আছে। গবেষণা ও উন্নয়নের জগতে ইসরায়েল বড় এক নাম।
কিন্তু ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করে। হামাসের সঙ্গে যুদ্ধের শেষ দেখা যাচ্ছে না। এখন তার ওপর হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় ইসরায়েলের অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে দেশটির নাগরিকেরা শঙ্কিত। তাঁদের ভাষ্য, দুটি যুদ্ধের ভার এই অর্থনীতি নিতে পারবে না।
Source : Washington Post
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন