আন্তর্জাতিক ডেস্ক: মাত্র ১৮ মাস আগে, হোয়াইট হাউজ ও পেন্টাগন কর্মকর্তারা বিতর্ক করেছিলেন ইউক্রেনে রুশ সেনাবাহিনী ভেঙে পড়া এবং ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড থেকে তাদের পুরোপুরি বিতাড়িত করার সম্ভাবনা নিয়ে। কিন্তু এখন, কয়েক মাস ধরে রাশিয়ার ধীরগতির ভূখণ্ডগত অগ্রগতি ও মার্কিন সরবরাহকৃত অস্ত্র মোকাবিলায় প্রযুক্তিগত উল্লম্ফন বাইডেন প্রশাসনকে ক্রমশ উদ্বিগ্ন করছে। তাদের আশঙ্কা, যুদ্ধের গতিপথ পাল্টে দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত গতি অর্জন করছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এক সময় যা ছিল পুতিনের জন্য হতাশাজনক, সেই পরিস্থিতি হয়ত পাল্টাচ্ছে। সম্প্রতি, মস্কোর সেনারা ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে নতুন স্থল অভিযান শুরু করেছে। এর ফলে ইতোমধ্যে সেনা ঘাটতিতে পড়া ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীকে নিজেদের শক্তি এখানে বাড়াতে হচ্ছে। ২০২২ সালে খারকিভ থেকে রুশদের বিতাড়িত করে বিস্ময়কর জয় পেয়েছিল ইউক্রেনীয় বাহিনী। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সরবরাহকৃত কামান ও ড্রোনগুলোকে অকার্যকর করে দিচ্ছে রাশিয়ার ইলেক্ট্রনিক যুদ্ধকৌশল। দেরিতে এই কৌশলের দ্বারস্থ হলেও তা কার্যকর বলে প্রমাণিত হচ্ছে। এছাড়া ইউক্রেনের ৬১ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সহযোগিতা পাঠানো হবে কিনা তা নিয়ে ওয়াশিংটনে বিতর্ক রাশিয়ার সামনে সুযোগ হাজির করে। যদিও কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবটিতে অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু রাশিয়া স্পষ্টভাবে সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে।
সাক্ষাৎকারে মার্কিন কর্মকর্তারা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো সব অস্ত্র ইউক্রেনের হাতে পৌঁছার পর নতুন দখল করা অনেক অঞ্চল থেকে রুশদের বিতাড়িত করা সম্ভব হবে। অনুমোদন পাওয়া প্যাকেজের সব অস্ত্র ইউক্রেনীয় সেনাদের হাতে পৌঁছাতে জুলাই মাস চলে আসবে। ওই সময়ের মধ্যে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও রণক্ষেত্রে আরও তরুণ সেনা পাঠানোর সুযোগ পেয়ে যাবেন। তবে কয়েক মাস পর লড়াইয়ের বর্তমান রেখা অটুট থাকবে কি না কিংবা আগামী বছর জেলেনস্কি নতুন পাল্টা আক্রমণ শুরু করতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে সংশয় রয়েছে। বিশেষ করে গত বছর ইউক্রেনীয় পাল্টা আক্রমণ ব্যর্থ হওয়ার পর এই দ্বিধা দেখা দিয়েছে। মার্কিন ও মিত্র দেশের কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন নিউ ইয়র্ক টাইমসের সঙ্গে। কিন্তু কিছু উদ্বেগ নিয়ে ইতোমধ্যে প্রকাশ্য মন্তব্যে উঠে এসেছে।
রবিবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, কোনও সন্দেহ নেই অস্ত্র পাঠাতে বিলম্বের মাশুল দিতে হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, সেখানে এই সহযোগিতা পাঠাতে আমরা সব কিছু করছি। কিন্তু মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, ইউক্রেনে পশ্চিমা দেশগুলোর সেনা পাঠানো হয়ত প্রয়োজনীয় বলে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ যে কথা বলে আসছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তা প্রত্যাখ্যান করে যাচ্ছেন। ম্যাক্রোঁর কার্যালয় সম্প্রতি বলেছে, তার এই পর্যালোচনা একেবারে সঠিক।
একান্ত আলাপে বাইডেনের উপদেষ্টাদের কয়েকজন উদ্বিগ্ন। তারা মনে করছেন, যুদ্ধ থেকে যুক্তরাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়েছে। তা হলো, কোন কোন প্রযুক্তি কাজে আসছে আর কী কাজে আসছে না। একইভাবে পুতিনও তা জেনে গেছেন। এই কর্মকর্তাদের বড় উদ্বেগের কারণ হলো, যুদ্ধের প্রথম ২৭ মাসে যেসব অস্ত্র হারিয়েছে রাশিয়া, সেগুলোর স্থলাভিষিক্ত করা হয়ে গেছে। আর পুতিন হয়ত নিজের পায়ের তলায় পুনরায় মাটি খুঁজে পাচ্ছেন। একই সময়ে বাইডেন আগামী মাসে ইতালিতে জি-৭ এর সম্মেলনে যোগ দেবেন। কিন্তু গত বছর ফিনল্যান্ডে পুতিন ‘ইতোমধ্যে যুদ্ধ হেরে গেছেন’ বলে যে মন্তব্য তিনি করেছিলেন সেটির পুনরাবৃত্তি তিনি এবার করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে সংশয় রয়েছে।
ঘটনার পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে অবাক হননি পুতিনকে ধারাবাহিকভাবে মোকাবিলা করা কয়েকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা। শুক্রবার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সম্মেলনে সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলে নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করা স্টিফেন জে. হ্যাডলি বলেছেন, প্রায় সময় রাশিয়া দুর্বলভাবে যুদ্ধ শুরু করে কিন্তু শেষ করে সবলভাবে। বিশাল জনসংখ্যা থেকে সেনা সংগ্রহ ও সামরিক অবকাঠামো দিয়ে ব্যর্থতা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে রাশিয়া। হ্যাডলি বলছেন, রণক্ষেত্রে মস্কোর সুবিধাজনক অবস্থানের জন্য একক কোনও কারণ নেই। একাধিক কারণ রাশিয়ার সামরিক অগ্রগতিতে সহযোগিতা করছে। মার্কিন সহযোগিতায় বিলম্বের কারণে কামানের সুবিধা ইউক্রেনের চেয়ে বেশি পেয়েছে রাশিয়া। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গোলার ঘাটতির কারণে রাশিয়া অনেকটাই নির্বিঘ্নে বিমান হামলা চালিয়ে যেতে পেরেছে। গ্লাইড বোমা নিয়ে ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা রেখায় আক্রমণ করেছে। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গোলাবারুদ পেলে ইউক্রেন হয়ত অনেক দূর থেকেই যুদ্ধবিমানে হামলা করতে পারত। এর ফলে বিমান হামলা চালাতে রাশিয়াকে আরও জটিলতায় পড়তে হতো। মার্কিন অস্ত্র সহযোগিতার মতো বিলম্বিত হয়েছে ইউক্রেনের নতুন সেনা সংগ্রহ। সেনা নিয়োগ আইন দেশটির পার্লামেন্টের পাস হতে অনেক সময় লেগেছে। সেনা ঘাটতি কমাতে তরুণদের নিয়োগে ঝুঁকেছিল ইউক্রেন। এছাড়া নতুন সেনাদের প্রশিক্ষণে পর্যাপ্ত সরঞ্জাম সরবরাহেও হিমশিম খাচ্ছে দেশটি।
ওয়াশিংটনভিত্তিক কার্নেগি এন্ডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর রাশিয়া বিশেষজ্ঞ মাইকেল কফম্যান বলছেন, কিন্তু রাশিয়ার এসব সুবিধা অনির্দিষ্টকাল থাকবে না। রুশ সেনারা সম্ভবত এই গ্রীষ্মে নতুন অভিযানের চেষ্টা করবে। ২০২৪ সালে রাশিয়া সরঞ্জামগত সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু কৌশলগত উদ্যোগগুলো হয়ত নির্ধারক হিসেবে প্রমাণিত হবে না। এই বছর রাশিয়ার সামনে একটি সুযোগ হাজির হয়েছে। কিন্তু রাশিয়া এই সুবিধাকে রণক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জনে কাজে লাগাতে না পারে এবং গতি অর্জন করতে না পারে তাহলে ২০২৫ সাল শুরুর দিকে তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
রাশিয়ার সুবিধা অস্থায়ী হোক বা না হোক, এর গতিশীলতা খারকিভে স্পষ্ট। ইউক্রেনের দ্বিতীয় শহরটিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বৃহত্তম ট্যাংক যুদ্ধগুলোর একটির রণাঙ্গন ছিল। ২০২২ সালে, যুদ্ধের প্রথম বছরে শহরটি অগ্রসর রুশ সেনাদের কামানের গোলার লক্ষ্যবস্তু ছিল। ওই বছরই আকস্মিক পাল্টা আক্রমণে ইউক্রেনীয় সেনারা রুশদের শহর থেকে বিতাড়িত করেছিল। পরে পুরো অঞ্চলও পুনরুদ্ধার করে। খারকিভ ও খেরসনে রাশিয়ার পিছু হটার ব্যর্থতা এত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল যে সংঘাতের সবচেয়ে বড় শঙ্কাটি ওই সময় দেখা গিয়েছিল। আর তা ছিল- রাশিয়া হয়ত যুদ্ধক্ষেত্রে শেষ হাতিয়ার হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে।
পুনরুদ্ধারের পর থেকে এলাকাগুলো থেকে রাশিয়াতে ছোট ছোট হামলা চালিয়েছে ইউক্রেন। এসব হামলার কারণে রাশিয়া পুনরায় এসব এলাকা দখলের পথে হাঁটছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একটি বাফার জোন গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছেন। সম্প্রতি ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান খারকিভের কাছে রুশ অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের কয়েকজন বিশেষজ্ঞ সতর্কতার সঙ্গে বলছেন, খারকিভে ভূখণ্ড দখলে রাশিয়ার প্রকৃত কৌশলগত লক্ষ্য হলো শহরটিতে অতিরিক্ত সেনা পাঠাতে ইউক্রেনকে বাধ্য করা। যাতে করে রণক্ষেত্রের অন্যত্র বাহিনীটি দুর্বল হয়। যা জুনে রাশিয়াকে আরেকটি অভিযান পরিচালনার সুযোগ এনে দেবে, বিশেষ করে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় ডনবাসে। কফম্যান বলেন, রাশিয়ার এই আক্রমণের লক্ষ্য হতে পারে ইউক্রেনের রিজার্ভ ও এলিট সেনাদের খারকিভে নিয়ে আসা। এতে অন্যত্র বাহিনীটি দুর্বল হবে। রাশিয়ার মূল লক্ষ্য এখনও ডনবাসের বাকি এলাকা দখল করা।
রাশিয়ার সেনাবাহিনী তা করতে সক্ষম হবে কিনা তার একাংশ নির্ভর করছে জেলেনস্কি নতুন সেনা সংগ্রহের উদ্যোগে কতটা সফল হন সেটির ওপর। দুই বছরের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ করা সেনাদের মনোবলে ঘাটতি ও অবসাদ দেখা দিয়েছে। নতুন সেনা নিয়োগের বয়সসীমা ২৭ থেকে কমিয়ে ২৫ করা হয়েছে। যদিও এতে ইউক্রেনীয়দের বিরোধিতা ছিল।
কিয়েভকে প্রযুক্তিগত পরামর্শ দেওয়া জোরদার করার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। বাইডেন প্রশাসন আশা করছে, এতে রাশিয়ার প্রযুক্তিগত অগ্রগতি মোকাবিলা করা যাবে। কিছু কিছু ঘটনায় রাশিয়া সফলভাবে জিপিএস রিসিভারকে ফাঁকি দিতে পেরেছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত হিমার্স ব্যবস্থাকে নিশানা করতে পেরেছে তারা। গত বছর এই অস্ত্র ইউক্রেনকে সরবরাহ করা শুরু করেছিলেন বাইডেন।
এসব অস্ত্র খুব গোপনীয়তার সঙ্গে ব্যবহার করে আসছিল ইউক্রেন। কিন্তু রাশিয়া এগুলোর গতিবিধি শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে আড়ালে থাকা অবস্থাতেও ধ্বংস করতে সক্ষমতা দেখিয়েছে।অবশ্যই, রণক্ষেত্রে রাশিয়ার এই সুবিধা খুব বেশিদিন থাকবে না। ১৮ মাস পূর্বে যুদ্ধ যে অবস্থায় ছিল আগামী ১৮ মাস পর হয়ত সেই অবস্থায় থাকবে না। কিন্তু বাইডেন প্রশাসনের ভেতরে ক্রমশ একটি মনোভাব গড়ে উঠছে যে, আগামী কয়েকটি মাস গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণিত হতে পারে। কারণ শেষ পর্যন্ত এক পর্যায়ে হয়ত উভয়পক্ষ একটি যুদ্ধবিরতির আলোচনায় যাবে। হয়ত ১৯৫৩ সালে কোরিয়া যুদ্ধের অবসানের মতো একটি চুক্তি যা লড়াই বন্ধ করেছিল অথবা একটি স্থবির সংঘাতে পরিণত হতে পারে।
সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস
ক্যাটাগরিঃ আন্তর্জাতিক
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন