চার বছরের বেশি সময় পর সম্প্রতি সুদহার কমিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ। দশমিক ৫০ শতাংশীয় পয়েন্টে সুদহার কমানোর পাশাপাশি মার্কিন আর্থিক নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটি নিকট-ভবিষ্যতে আরো কাটছাঁটের ইঙ্গিত দিয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের কারো কারো মতে, আগামী বছর দেশটিতে মূল্যস্ফীতির পুনরুত্থান ঘটতে পারে। এতে সুদহার হ্রাসের নতুন চক্রটি অব্যাহত রাখার সক্ষমতা সীমিত হবে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৪ দশমিক ৭৫ থেকে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করে ফেড। কভিড-১৯ মহামারী শুরুর দিকের জরুরি ব্যবস্থা বাদ দিলে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক শেষবার ২০০৮ সালে ৫০ বেসিস পয়েন্ট সুদহার কমিয়েছিল, যখন বৈশ্বিক আর্থিক সংকট কাটাতে বিশেষ প্রণোদনার প্রয়োজন হয়েছিল।
মহামারীর শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে সুদহার শূন্যের কাছাকাছি ছিল। সেদিকে আর ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানান ফেডের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল। সঙ্গে যোগ করেন, ‘সুদহার আরো কমানোর জন্য সুযোগ খুঁজছে ফেড।’ ফেডের বিশেষজ্ঞরা আভাস দিয়েছেন, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে সুদহার অতিরিক্ত দশমিক ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট কমতে পারে।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক সংস্থা আইটিআর ইকোনমিকসের অর্থনীতিবিদ লরেন সাইডেল-বেকার বলেন, ‘যদিও একদম শুরুতে ৫০ বেসিস পয়েন্টে সুদহারে কাটছাঁট অস্বাভাবিক, তবে এটি ফেডের ইতিহাসে নজিরবিহীন নয়।’
সুদহার কমানোর জন্য মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ২ শতাংশে নির্ধারণ করেছিল ফেড। সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতিতে মন্থরতা দেখা যায়, যা মার্কিন অর্থনীতিকে মন্দার আশঙ্কা থেকে রক্ষা করেছে। সেই সূত্রে সুদহার কমে আসে, যা সর্বশেষ ১৪ মাস ধরে দুই দশকের সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ৩ শতাংশে স্থির ছিল।
সুদ কমানোর আগে এর হার নিয়ে চলছিল নানা জল্পনা। লরেন সাইডেল-বেকারের মতে, ২৫ নাকি ৫০ বেসিস পয়েন্টে কাটছাঁট আসবে—এ প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে গেছে। এখন পুরো চক্রকে সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে, যেখানে আরো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়ে গেছে।
কারণ হিসেবে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যকে সামনে আনলেন এ বিশ্লেষক। লরেন সাইডেল-বেকারের মতে, বেকারত্বের হার ও মূল্যস্ফীতির নিরিখে এখনো ফেডের উদ্বেগ কাটেনি। মূল্যস্ফীতি কমলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনায় বৃদ্ধির হার বেশি। ফেডের ভোক্তা মূল্যসূচক পিসিই এখনো ২ শতাংশ লক্ষ্যের ওপরে রয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে মূল ভোক্তা মূল্যসূচক ২০২৩ সালের তুলনায় জুলাইয়ে ২ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে, যা জুনের সঙ্গে অপরিবর্তিত ছিল। মাসিক ভিত্তিতে জুলাইয়ে বেড়েছে দশমিক ২ শতাংশ, জুনেও একই হার বহাল ছিল।
খাদ্য ও জ্বালানি দাম অন্তর্ভুক্ত থাকা পিসিই মূল্যসূচক ২০২৩ সালের একই সময়ের তুলনায় জুনে ২ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধির পর জুলাইয়ে আবারো বাড়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ। মাসিক ভিত্তিতে জুনে দশমিক ১ শতাংশের পর জুলাইয়ে এ সূচক দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে।
সাম্প্রতিক তথ্য-উপাত্তের বরাতে লরেন সাইডেল-বেকার জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক অর্থনীতিতে শ্লথগতি বিদ্যমান। কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে মন্থর গতি বা বেকারত্ব বৃদ্ধি শ্রমবাজারের দুর্বলতার লক্ষণ প্রকাশ করছে, যা পুরো অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
এ বিশ্লেষক বলেন, ‘তবে অর্থনীতির মৌলিক সূচকগুলো এখনো মন্থর গতি থেকে অনেক দূরে, যা সুদহার কমানোর গতিকে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করবে।’
ফেডারেল ওপেন মার্কেট কমিটির (এফওএমসি) বিবৃতি ও ফেডের চেয়ার জেরোম পাওয়েলের প্রেস কনফারেন্স উভয়ই শ্রমবাজারের দিকে অনেক বেশি মনোযোগ দিয়েছে। ওই সময় পাওয়েল জানিয়েছিলেন, মার্কিন শ্রম
বাজার ‘স্থিতিশীল’ ও দেশটির অর্থনীতি ‘ভালো অবস্থায়’ রয়েছে। ফেডের বর্তমান লক্ষ্য হলো মূল্যস্ফীতির স্তর স্থিতিশীল রাখা এবং একই সময়ে বেকারত্বের হার যাতে আর না বাড়ে তা নিশ্চিত করা।
ফেডের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা এমন একটি লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করছি যেখানে বেকারত্বের গুরুতর বৃদ্ধি ছাড়াই মূল্য স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করা যাবে। কেননা কখনো কখনো মূল্যস্ফীতি হ্রাসে মন্থর গতির কারণে বেকারত্ব বেড়ে যায়।’
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংস্থা অ্যাপোলো গ্লোবাল ম্যানেজমেন্টের অংশীদার ও প্রধান অর্থনীতিবিদ টরস্টেন স্লোকের মতে, আর্থিক খাতে শিথিল পরিবেশ তৈরি করতে সুদহার কাটছাঁটের চক্র শুরু করেছে ফেড। তা সত্ত্বেও সুদহার দীর্ঘ সময়ের জন্য অপেক্ষাকৃত বেশি থাকতে পারে।
টরস্টেন স্লোক বলেন, ‘যদি ধরে নিই এ বছর ফিউচার মার্কেটে মূল্য নির্ধারণে সুদহারের অন্তত চারটি কাটছাঁট সঠিক, যা অনেক বেশি বলে আমি মনে করি। বছরের শেষ নাগাদ স্বল্পমেয়াদি সুদহার প্রায় ৪ দশমিক ৫ শতাংশ হবে, যা ২০০৭ সালের তুলনায় সর্বোচ্চ থাকবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা যদি ২০২৫ সালে অতিরিক্ত পাঁচটি সুদহার কাটছাঁট প্রত্যাশা করি, তবে তা আগামী বছরের শেষ নাগাদ হার ৩ শতাংশে পৌঁছাবে, যা গত এক দশকের গড় ১ দশমিক ৮ শতাংশের প্রায় দ্বিগুণ।’
ফেডের ইঙ্গিত অনুসারে, এ বছরের শেষ নাগাদ সুদহার অতিরিক্ত ৫০ বেসিস পয়েন্টে কমতে পারে। পরের বছর ২৫ বেসিস পয়েন্টে আরো চারবার সুদহার কমাতে পারে এবং ২০২৬ সালের ২৫ বেসিস পয়েন্টে দুবার কমাতে পারে।
টরস্টেন স্লোকের মতে, মূল্যস্ফীতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রত্যাশিত ২ শতাংশ লক্ষ্যে নামতে আরো বেশি সময় লাগবে। কারণ হিসেবে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সুদহারের ব্যবধানকে উল্লেখ করেন তিনি। (খবরঃ আনাদোলু)
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন