বিগত এক দশকে সমুদ্র থেকে বাণিজ্যিক জাহাজের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে মাছের আহরণ বাড়লেও সমাপ্ত অর্থবছরে কমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আহরণ হয়েছিল ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৭ টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩১ হাজার ২৩৩ টন কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৮০৪ টন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে মাছ আহরণ কমেছে ২১ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বছরে ছয় মাস সমুদ্র থেকে মাছ আহরণ করা হয়। কিন্তু মাছ ধরার মৌসুমে বাংলাদেশের জলসীমানায় জেলি ফিশ বেড়ে যাওয়ায় আহরণ কমে গেছে। পাশাপাশি বাণিজ্যিক জাহাজের জ্বালানি খরচও বেড়েছে। ফলে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন উদ্যোক্তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমুদ্রে জেলি ফিশ বাড়লে অন্য মাছের আনাগোনা কমে যায় এবং অবস্থান শনাক্ত করা যায় না। তাছাড়া সামুদ্রিক দূষণও বেড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে সামুদ্রিক মাছ আহরণ হুমকির মুখে পড়তে পারে।
সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাণিজ্যিক জাহাজগুলো গত নয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ইলিশ মাছ আহরণ করেছে। যার পরিমাণ মাত্র ২ হাজার ৩৬৮ টন। অথচ ২০২২-২৩ অর্থবছরে আহরিত হয়েছিল ৮ হাজার ১৩৮ টন। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে ইলিশ মাছের আহরণ কমেছে ৫ হাজার ৭৭০ টন বা ৬৯ শতাংশ।
অন্যদিকে ইলিশসদৃশ সার্ডিন মাছের আহরণ কমে অর্ধেকেরও নিচে নেমেছে। বিগত ২০২২-২৩ অর্থবছরে যেখানে রেকর্ড ৫০ হাজার ৭৮৩ টন সার্ডিন মাছ ধরা হয়েছিল, সেখানে সমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ধরা হয়েছে মাত্র ২৩ হাজার ৬৫ টন। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে কমেছে ২৭ হাজার ৭১৮ টন বা ৫৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। সমাপ্ত অর্থবছরে এ মাছের আহরণ হয়েছে গত ১০ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন।
এছাড়া চিংড়ির আহরণও গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মাত্র ১ হাজার ৯৫৪ টন চিংড়ি আহরিত হয়েছে।
গত ছয় বছরের বাণিজ্যিক জাহাজের মৎস্য আহরণের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ লাখ ৭ হাজার ২৩৬ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ লাখ ১৫ হাজার ৩৫৪, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ লাখ ১৯ হাজার ১২১, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ লাখ ৩৭ হাজার ১৭০, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৭ (রেকর্ড) এবং সর্বশেষ গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ লাখ ১৪ হাজার ৮০৪ টন মাছ সমুদ্র থেকে আহরণ করা হয়।
সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. শওকত কবির চৌধুরী বণিক বার্তাকে জানান, টানা পাঁচ বছরের ঊর্ধ্বগতির পর সমাপ্ত অর্থবছরে সমুদ্র থেকে বাণিজ্যিক জাহাজে মাছ আহরণ কমেছে। সমুদ্রে জেলি ফিশ বেড়ে যাওয়ায় যারা বৃহৎ পরিসরে মাছ আহরণে গভীর সমুদ্রে যাচ্ছেন তারা খালি হাতে ফিরে আসছেন। জাহাজের খরচ তুলতে না পেরে মালিকরা ট্রিপ কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে সামুদ্রিক মাছ আহরণও নিম্নমুখী হয়েছে।
সামুদ্রিক মৎস্য জরিপ ব্যবস্থাপনা ইউনিটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মঈন উদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সমুদ্রে ইলিশ বা সার্ডিন মাছ বেশি ধরা পড়ে। কিন্তু গত অর্থবছরে এ মাছের প্রাপ্যতা কমে গেছে। ছোট নৌযানেও বিগত বছরগুলোর মতো ইলিশ মাছ দেখা যায়নি। তবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রকাশ করা সম্ভব হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সমুদ্রে জেলি ফিশ এভাবে কেন বাড়ল সে বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমাদের সমুদ্রসীমায় জেলি ফিশের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া অন্যান্য মাছের জন্য অ্যালার্মিং।’
তথ্যমতে, সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরের নিবন্ধিত বাণিজ্যিক ট্রলার রয়েছে ২৬৩টি। যার মধ্যে প্রায় ২২০টি নিয়মিত সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। এছাড়া যান্ত্রিক নৌযানের অনুমোদন রয়েছে প্রায় ৬৬ হাজারের। বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর মধ্যে কাঠের তৈরি নৌযানের মাছ আহরণক্ষমতা ৪৫-৫০ টন এবং স্টিল বডির জাহাজগুলোর ধারণক্ষমতা সর্বোচ্চ ৪০০-৪৫০ টন।
বাণিজ্যিক জাহাজের প্রতিনিধিরা জানান, গত নভেম্বর থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত সমুদ্রে জেলি ফিশের আধিক্যের কারণে মাছ আহরণ করা যায়নি। পাশাপাশি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে জাহাজগুলো এখন পরিচালন ব্যয় মেটাতে পারছে না। বড় বাণিজ্যিক জাহাজগুলোয় গড়ে এক ট্রিপে সাড়ে পাঁচ হাজার থেকে আট হাজার লিটার ডিজেলের প্রয়োজন হয়। অন্যান্য ব্যয়সহ ২০ থেকে ২২ দিনের জন্য প্রতি ট্রিপে এক-দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। অনেকেই খরচের ভয়ে জাহাজ সমুদ্র উপকূলে নোঙর করে রেখেছেন।
বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ মো. নজরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত অর্থবছরে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার সময়ে অনাবৃষ্টি ও পানিতে অক্সিজেন কমে গিয়ে সমুদ্র দূষিত হয়ে পড়ে। ফলে বাংলাদেশের জলসীমা জেলি ফিশের জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠে। যার কারণে আমরা মাছ ধরতে পারিনি। তবে দুই-তিন মাস ধরে প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ায় সমুদ্রে অক্সিজেনের পরিমাণ স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে, মাছের পরিমাণও বেড়েছে। যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমরা এখনো মাছ ধরতে পারছি না।’
আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হবে বলে আশা করছেন তিনি।
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন