গাজায় চলমান সংঘাত এ অঞ্চলের আগের যেকোনো যুদ্ধকে ছাড়িয়ে গেছে। দুই দশকের মধ্যে ২০০৮, ২০১২, ২০১৪ ও ২০২১ সালে দুই পক্ষ বড় আকারের সংঘাতে লিপ্ত হয়। কিন্তু এর কোনোটিই ফিলিস্তিনের জন্য এবারের মতো বিপর্যয়কারী হয়নি। বিষয়টি উল্লেখ করে জাতিসংঘ জানিয়েছে, ফিলিস্তিনের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে কয়েক দশক সময় লাগবে।
সম্প্রতি ‘ডেভেলপমেন্টস ইন দ্য ইকোনমি অব দ্য অকুপাইড প্যালেস্টাইন টেরিটরি’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে ইউএন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলমেন্ট (ইউএনসিটিএডি)। যেখানে বলা হচ্ছে, ২০২৩ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) গাজার জিডিপি ৮১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, এর প্রভাবে পুরো বছরের জিডিপি সংকুচিত হয় ২২ শতাংশ। গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বেকারত্ব ছিল ৪৬ শতাংশ। কিন্তু অক্টোবরে যুদ্ধ শুরু হলে বছরের শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) বেকারত্ব বেড়ে দাঁড়ায় ৭৯ শতাংশ।
ফিলিস্তিনের অর্থনীতি ২০২৩ সালের প্রথম তিন প্রান্তিকে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ৮ শতাংশ সম্প্রসারিত হয়েছিল, কিন্তু অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে তা ৩০ শতাংশ সংকুচিত হয়। ফলে বার্ষিক জিডিপিতে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ সংকোচন হয় এবং মাথাপিছু জিডিপি হ্রাস পায় ৮ শতাংশ। একে সাম্প্রতিক ইতিহাসে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় পতনগুলোর একটি বলে উল্লেখ করা হচ্ছে প্রতিবেদনে।
২০০০ সালে শুরু হয়ে কয়েক বছর ধরে চলে ফিলিস্তিনিদের ডাক দেয়া দ্বিতীয় ইন্তিফাদা। এর অর্থনৈতিক প্রভাব ফিলিস্তিনের ওপর আরো কয়েক বছর চলমান ছিল। কিন্তু এবার সৃষ্ট অর্থনীতির এ ক্ষতি পূরণ করতে কয়েক দশক সময় লাগবে। এছাড়া আর্থসামাজিক পরিসরে বড় আকারের ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিক্রিয়া দীর্ঘ সময় ধরে অনুভূত হবে।
মে মাসে বিশ্বব্যাংক এক পূর্বাভাসে জানিয়েছিল, ফিলিস্তিনি অর্থনীতি চলতি বছর ৬ দশমিক ৫ থেকে ৯ দশমিক ৪ শতাংশের মধ্যে সংকুচিত হতে পারে।
এবারের সংঘাতে গাজা উপত্যকায় প্রায় দুই লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। অধিকৃত পশ্চিম তীরে কাজের সুযোগ হারিয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার ফিলিস্তিনি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) পূর্বাভাস অনুসারে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ফিলিস্তিনে সামগ্রিক বেকারত্বের হার ৫৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিন সরকার কর্মচারীদের আংশিক বেতন দিচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারির হিসাবে, কর্মচারীদের ৪ দশমিক ৩ মাসের বকেয়া পাওনা ছিল। এর মধ্যে গাজার বকেয়া ৪ কোটি ৮৪ লাখ ডলার এবং পশ্চিম তীরে ১০ কোটি ২৭ লাখ ডলার। এছাড়া পশ্চিম তীরে বেসরকারি খাতের ৪০ শতাংশ কর্মীর মজুরি প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে।
চাকরি হারানোর ফলে প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি ১৭ লাখ ডলারের আয় হারাচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। সরকারি ও বেসরকারি খাতে কমে যাওয়া বেতন যোগ করলে তা দাঁড়াবে ২ কোটি ৫৫ লাখ ডলারে।
ইউএনসিটিএডি বলছে, ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিনে উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে বা ধ্বংস হয়েছে, আয়ের উৎস উধাও হয়ে গেছে, দারিদ্র্য আরো তীব্র ও প্রসারিত হয়েছে। গাজার প্রায় সব মানুষকে দারিদ্র্য প্রভাবিত করছে এবং পশ্চিম তীরেও তা দ্রুত বাড়ছে। এ বছরের শুরুতে গাজার ৮২ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত বা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসের খবর পাওয়া গেছে। অন্যদিকে পশ্চিম তীরে বেসরকারি খাতের ৯৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে বিক্রি কমেছে এবং ৪২ দশমিক ১ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে কর্মী কমেছে।
যুদ্ধের প্রভাবে ২০২৩ সালের জন্য দেয়া অর্থনৈতিক পূর্বাভাস ও বাস্তব অবস্থার মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান দেখা দিয়েছে। পূর্বাভাসে ৫ শতাংশ রফতানি বৃদ্ধির কথা বলা হলেও তা হয়েছে ২ দশমিক ৯ শতাংশ। ৫ শতাংশ আমদানি বৃদ্ধির পূর্বাভাসের বিপরীতে সংকুচিত হয়েছে ২ দশমিক ৬ শতাংশ। পরিষেবা খাতে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসের তুলনায় সংকুচিত হয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ৩ দশমিক ২ শতাংশ সম্প্রসারণের পূর্বাভাসের বিপরীতে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে শিল্প খাত। কৃষি খাতে ১ শতাংশ সংকোচনের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল, কিন্তু সংকোচন হয়েছে ১১ দশমিক ৩ শতাংশ।
এ বছরের শুরুতে গাজার ৮০-৯৬ শতাংশ কৃষিসম্পদ, সেচ ব্যবস্থা, গবাদি পশুর খামার, বাগান, যন্ত্রপাতি ও মজুদাগার ধ্বংস হয়ে গেছে, যা খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত করার পাশাপাশি আগের থেকে বিদ্যমান মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাকে আরো খারাপ করেছে।
ফিলিস্তিনের অর্থনীতি অনেকটাই আন্তর্জাতিক সাহায্যনির্ভর, সেখানেও মন্দা দেখা দিয়েছে। ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক সাহায্য ৩৫ কোটি ৮০ লাখ ডলারে নেমে আসে যা জিডিপির মাত্র ২ শতাংশের সমতুল্য। অন্যদিকে ২০০৮ সালে পাওয়া সহায়তা ২০০ কোটি ডলার ছিল জিডিপির ২৭ শতাংশ।
প্রতিবেদনে ইউএনসিটিএডি জোর দিয়ে বলেছে, দীর্ঘায়িত দখল ফিলিস্তিনের অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। বিনিয়োগ, শ্রমের গতিশীলতা ও বাণিজ্যের ওপর পদ্ধতিগত বিধিনিষেধ অঞ্চলটির অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে হ্রাস করেছে। এ কারণে বেড়েছে দারিদ্র্য ও অস্থিতিশীলতা। এর বিপরীতে ফিলিস্তিনিদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন অধিকৃত ভূখণ্ডে ব্যাপক পুনরুদ্ধার, আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সমর্থন বৃদ্ধি, ইসরায়েলে আটকে থাকা রাজস্ব উদ্ধার ও গাজার ওপর থেকে অবরোধ প্রত্যাহার। বিষয়গুলো উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবিলম্বে ও যথাযথ হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের সংস্থাটি। (খবরঃ দ্য ন্যাশনাল)
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন