শ্লথ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাঝে ইউরোপে ক্রমেই বাড়ছে জীবনযাত্রা ব্যয়। সাম্প্রতিক এক জরিপে ৯০ শতাংশের বেশি ইউরোপীয় দৈনন্দিন খরচকে ‘চাপ’ উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ইউরো নিউজের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, গৃহস্থালি খরচের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাপ হিসেবে কাজ করছে আবাসন খাত। দেশভেদে আয়ের এক-পঞ্চমাংশের বেশি খরচ হচ্ছে এ বাবদ।
২০২২ সালে প্রকাশিত ডাটা থেকে দেখা যাচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) পারিবারিক খরচের বড় অংশ যায় আবাসন খাতে। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানি বিল। সব মিলিয়ে খাতটি কেড়ে নেয় মোট খরচের ২৪ দশমিক ১ শতাংশ। এরপর রয়েছে খাদ্য ও নন-অ্যালকোহলযুক্ত পানীয়, যা মোট খরচের ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে পরিবহন বাবদ ব্যয় হয় ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। এ খাতগুলোয় খরচের পরিমাণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়লেও হিস্যা প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে।
২০০২ ও ২০২২ সালের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে, গৃহস্থালি খরচে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে, যা ২১ দশমিক ১ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৪ দশমিক ১ শতাংশ, যা দুই দশকে ৩ শতাংশীয় পয়েন্ট (পিপি) বৃদ্ধির প্রতিনিধিত্ব করে। এর মানে হলো ২০০২ সালে একটি পরিবারের মোট ব্যয় ১ হাজার ইউরো হলে আবাসনে হিস্যা ছিল ২১১ ইউরো, যা ২০২২ সাল নাগাদ বেড়ে হয়েছে ২৪১ ইউরো। প্রতিবেদন অনুসারে, ইউরোপে আবাসনের দাম ও জ্বালানি খরচ দীর্ঘমেয়াদে বৃদ্ধির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয়কে প্রভাবিত করেছে। মূলত অত্যাবশ্যকীয় ব্যয় কমানোর উপায় না থাকায় ইউরোপীয় পরিবারগুলোর ওপর বৃহত্তর আর্থিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
তুলনামূলক খাত বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, দুই দশকে আবাসন খরচ ১৪ শতাংশ বাড়লেও স্বাস্থ্য ব্যয় বেড়েছে ২২ শতাংশ। কিন্তু সামগ্রিক ব্যয়ের বড় একটি অংশ আবাসনের জন্য নির্ধারিত হওয়ায় স্বাস্থ্য ব্যয়ের তুলনায় জীবনযাত্রায় এর প্রভাব বেশি। চলতি শতকের শুরুর দিকের পর আবাসন ও পরিষেবা ব্যয়ের অংশ ক্রমাগত বেড়ে ২০ শতাংশে পৌঁছায়, যা ২০১৩ সালে প্রায় ২৫ শতাংশ ছুঁয়ে যায়। এরপর সামান্য নিম্নমুখী প্রবণতার পর কভিড-১৯ মহামারীর সময় আবাসন ব্যয় শীর্ষে ওঠে। ২০২০ সালে তা রেকর্ড ২৫ দশমিক ৬ শতাংশে পৌঁছে। তবে ২০২২ সালের পর খরচ আবারো কমতে শুরু করে।
গত দুই দশকে আবাসন ও পরিষেবা ব্যয়ের সামগ্রিক বৃদ্ধি নির্দেশ করে যে এ খরচগুলো পরিবারের বাজেটে বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে, যা বৃহত্তর অর্থনৈতিক চাপ ও ইইউজুড়ে জীবনযাত্রার ব্যয়ের পরিবর্তনকে তুলে ধরে। কিছু দেশে দুই দশকে ব্যয় বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ২০০২-২২ সালের মধ্যে আবাসন ভাড়া, পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস খরচ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে আয়ারল্যান্ডে, ৭ দশমিক ১ শতাংশ। এরপর স্পেন ও ইতালিতে বেড়েছে যথাক্রমে ৬ দশমিক ৩ ও ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। এছাড়া আবাসন বাবদ ইইউ অঞ্চলের ১০টি দেশে খরচ বাড়ার হার ৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যা অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ব্যয়ের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা তুলে ধরেছে।
তবে সুইডেন, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি পূর্ব ইউরোপীয় দেশে আবাসনের ব্যয় কিছুটা কমেছে। বিশেষ করে রোমানিয়ায় ৪ দশমিক ১ শতাংশ খরচ কমেছে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য কমেছে বসনিয়া-হার্জেগোভিনা ও সার্বিয়ায়।
সামগ্রিক ব্যয়ে আবাসনে হিস্যা ইউরোপজুড়ে উল্লেখযোগ্যভাবে পার্থক্য বজায় রেখেছে। যেমন ২০২২ সালে স্লোভাকিয়ায় পরিবারিক ব্যয়ের ৩০ শতাংশ দখলে নিয়ে আবাসনে শীর্ষে উঠে আসে। অন্যদিকে ফিনল্যান্ড ও ডেনমার্কে হিস্যা ছিল যথাক্রমে ২৯ দশমিক ৬ ও ১৯ দশমিক ১ শতাংশ।
ইউরোপের শীর্ষ অর্থনীতিগুলোয় আবাসন খরচ উদ্বেগজনকভাবে বেশি। এতে ভাড়া বাসায় থাকা ব্যক্তিরা বেশি প্রভাবিত হয়। ২০২২ সালে যুক্তরাজ্যের অর্ধেকের মতো স্বল্প আয়ের ব্যক্তি তাদের আয়ের ৪০ শতাংশের বেশি বাসা ভাড়ায় ব্যয় করেছে। ফ্রান্স ও ইতালিতে এ হার যথাক্রমে ৩২ ও ২৮ শতাংশ।
উত্তর ও মধ্য ইউরোপীয় দেশে আবাসন ও পরিষেবাসংশ্লিষ্ট আর্থিক চাপ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এর বিপরীতে মন্টেনিগ্রো, তুরস্ক ও আলবেনিয়ার মতো দক্ষিণ ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোয় খরচ অনেক কম। মন্টেনিগ্রোয় আবাসন বাবদ মাত্র ১১ দশমিক ৬ এবং তুরস্ক ও আলবেনিয়ায় যথাক্রমে ১২ দশমিক ৪ ও ১২ দশমিক ৫ শতাংশ আয় খরচ হয়।
আবাসন খরচ নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত করেছে। অরগানাইজেশন ফর ইকোনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবাসন খরচ পরিবারগুলোর ওপর উচ্চ আর্থিক বোঝা চাপিয়ে দিতে পারে, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো বেশি প্রভাবিত হতে পারে।
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন