বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনাঃ শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে ট্রাম্পের ওপর – The Finance BD
 ঢাকা     শনিবার, ২৩ অগাস্ট ২০২৫, ০৭:৪৭ অপরাহ্ন

বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনাঃ শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে ট্রাম্পের ওপর

  • ১৩/০৭/২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিতীয় দফায় তিন দিনব্যাপী বাণিজ্য আলোচনা গতকাল শেষ হয়েছে। বেশকিছু বিষয়ে একমত হয়েছে দুই দেশ। তবে কয়েকটি বিষয় অমীমাংসিত রয়ে গেছে বলে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে। মার্কিন বাজারে বাংলাদেশী পণ্য রফতানিতে উচ্চহারে ধার্য শুল্ক কমানোর বিষয়টি অবশ্য ফলপ্রসূ হয়নি। এ তথ্য নিশ্চিত করে অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, শুল্ক হ্রাসের বিষয়টি নির্ভর করছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর। তিনি চাইলেই কেবল এটি হতে পারে। তাছাড়া শুল্কের বিষয় আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসার সিদ্ধান্তটিও ট্রাম্পের। তাই এখনো আশা ছাড়ছে না বাংলাদেশ।
ওয়াশিংটনে ৯-১১ জুলাই বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের মধ্যে বৈঠক হয়। শুরুর দিন এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তর ইউএসটিআরের আমন্ত্রণে ‘‍এগ্রিমেন্ট অন রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ শীর্ষক দরকষাকষির দ্বিতীয় দফার আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা। বৈঠক শেষে জানানো হয়, দ্বিতীয় দফায় প্রথম দিন ‘শুল্ক’ আলোচনার পরিসর ছিল বিস্তৃত, যেখানে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে আসে।
দ্বিতীয় দিনের বৈঠক শেষে প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, ‘শুল্ক’ আলোচনায় দুই দেশের মধ্যে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বাণিজ্যের গতি-প্রকৃতি কেমন হবে সেসব বিষয় উপস্থাপন ও যুক্তিতর্ক হয়। বেশকিছু বিষয়ে দুই দেশ মোটামুটিভাবে একমত হয়েছে। কিছু বিষয় অবশ্য অমীমাংসিত রয়ে গেছে। তৃতীয় ও শেষ দিনের বৈঠক শেষে গতকাল জানানো হয়, দ্বিতীয় দফার ‘বাণিজ্য’ আলোচনার তৃতীয় ও শেষ দিনে আরো কিছু বিষয়ে একমত হয়েছে দুই দেশ। তবে কয়েকটি বিষয় এখনো অমীমাংসিত।
সূত্র জানিয়েছে, তিনদিনের আলোচনায় মূলত বাণিজ্যিক বিধিমালার বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে। আর এ আলোচনা অব্যাহত থাকবে। বৈঠকে সরাসরি অংশ নেয়া বাংলাদেশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আলোচনা এখন পর্যন্ত একটা পজিটিভ জায়গায় আছে। ফাইনালি (চূড়ান্তভাবে) কী হবে বলা মুশকিল।’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণা অনুযায়ী ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা। তবে সেটি কমিয়ে আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। নির্ধারিত সময়ে আগে শুল্কের বিষয়ে কোনো পরিবর্তন আসতে পারে কিনা, জানতে চাইলে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশসংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, ‘‍অবশ্যই আসতে পারে। তবে তার আগে আরো আলোচনা হবে দুই দেশের মধ্যে।’ আলোচনার ধরন দেখে নিশ্চিতভাবে পরিবর্তন আসবে বলেও আশা প্রকাশ করা হয়।
শুল্কহারে পরিবর্তন বা এ নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্তের এখতিয়ার একমাত্র ট্রাম্পের—তা নিশ্চিত করে সূত্র জানায়, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত কী হবে সেটা নিয়ে আগে থেকে কিছু ভাবার সুযোগ নেই। ‍তবে সেখানে আলোচনাও ‘ফ্যাক্টর’। কারণ হিসেবে বলা হয়, শুল্কের বিষয়টি আলোচনার টেবিলে আনার পরিকল্পনা ট্রাম্পেরই।
প্রথমদিনের বৈঠক শুরুর আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছিল, আলোচনার পুরো প্রক্রিয়াটি শুধু যদি শুল্ক বা ট্যারিফের গল্প হতো তাহলে বিষয়টি অনেক সহজ ছিল। এটা ট্যারিফের গল্প না, গল্পটি ট্রেডের। ‘ট্রেড’ শব্দটি গোটা বিষয়টির জটিলতা শত গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। ট্রেড করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধরনের বাধ্যবাধকতা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। কিছু বাধ্যবাধকতা দেশের অর্থনীতির সক্ষমতার বাইরে। এমনকি সেগুলো অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আর বাণিজ্য বিষয়ক বাধ্যবাধকতাগুলো মেনে নিতে চাপ সৃষ্টির জন্যই গত ৭ জুলাই বাংলাদেশের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্কহার আরোপের ঘোষণা দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ব্যবসায়ীরা অবশ্য বলছেন, তিনদিনের আলোচনায় শুল্কহার নিয়ে কোনো ইতিবাচক কিছুই হয়নি। কারণ এ আলোচনা নিয়ে প্রস্তুতির ঘাটতিতে বাংলাদেশের প্রস্তাব নিয়ে আগেই সন্তুষ্ট হতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র পক্ষ। সে সুযোগেই ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন ট্রাম্প।
এদিকে আরোপিত শুল্কের প্রভাব এরই মধ্যে টের পেতে শুরু করেছেন রফতানিকারকরা। বাড়তি শুল্কের কারণে বাংলাদেশ থেকে ক্রেতারা ভিয়েতনামমুখী হচ্ছেন। সুনিভার্স ফুটওয়ার লিমিটেড যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভেনিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের কাছে নন-লেদারের জুতা রফতানি করে থাকে। সম্প্রতি কোম্পানিটিকে ক্রয়াদেশ দেয়ার জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের এক ক্রেতা। তবে শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর তিনি ক্রয়াদেশ না দিয়েই ভিয়েতনামে চলে যান।
এ তথ্য জানিয়ে সুনিভার্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াদ মাহমুদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ওই ক্রেতার বাংলাদেশে অবস্থানকালীন আমার সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে শুল্ক আরোপের ঘোষণা এলে তিনি কোনো কিছু না জানিয়েই বাংলাদেশ ছেড়ে যান। পরে আমরা জানতে পারি যে তিনি ভিয়েতনামে চলে গেছেন। শুল্ক ঘোষণার আগে ওই ক্রেতা আমাদের কাছ থেকে জুতা নিতে আগ্রহী ছিলেন। আমি প্রথমবারের মতো এ ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি।’ দরকষাকষির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে শুল্কছাড় আদায় করা সম্ভব না হলে বাংলাদেশের ক্রেতা ভিয়েতনামসহ অন্যান্য বাজারমুখী হয়ে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এ ব্যবসায়ী।
পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরাও একই আশঙ্কা করছেন। তারা বলছেন, এ খাতের চলমান ক্রয়াদেশ স্থগিত হওয়া থেকে শুরু করে শুল্কহারের বোঝা এককভাবে বহন করা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা। বিশ্বখ্যাত ওয়ালমার্টও বাংলাদেশের পোশাকের কিছু ক্রয়াদেশ পিছিয়ে দিয়েছে, কিছু ক্রয়াদেশ স্থগিত করেছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ তথ্য জানিয়ে বলছে, আগামী ১ আগস্ট থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাবিত শুল্ক কার্যকর হলে ক্রয়াদেশ কমে যাবে বলে জানিয়েছেন কারখানা মালিকরা। কারণ ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত খরচ তারা বহন করতে পারবেন না।
রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর গত ২ এপ্রিল শুল্ক আরোপ করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বাংলাদেশের ওপর আরোপ করা শুল্কহার ঘোষণা দেয়া হয় ৩৭ শতাংশ। এরপর ৯ এপ্রিল তিন মাসের জন্য সেই ঘোষণা তিনি স্থগিত করেন। ওই সময়ে বাংলাদেশসহ সব দেশের ওপর ১০ শতাংশ হারে শুল্ক প্রযোজ্য ছিল। তিন মাস শেষ হওয়ার আগেই বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশের জন্য নতুন শুল্কহার ঘোষণা করেন ট্রাম্প।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হওয়া বাংলাদেশের প্রধান পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক। এছাড়া অন্য পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে হেডগিয়ার, জুতা, অন্যান্য বস্ত্রপণ্য, পালক এবং পালক দ্বারা তৈরি সামগ্রী, চামড়াজাত পণ্য, মাছ, শস্যদানা, আসবাব প্রভৃতি।
অর্থমূল্য বিবেচনায় বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হওয়া মোট পণ্যের ৮৭ শতাংশই তৈরি পোশাক। এ খাতের প্রতিনিধিরা শুল্ক কমে আশার বিষয়ে এখনো আশাবাদী। বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তিনদিনের বৈঠকে যারা সরাসরি যুক্ত ছিলেন তারা শুল্ক কমার বিষয়ে আশাবাদী। কাজেই আমাদের নিরাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। বৈঠকে আমি উপস্থিত ছিলাম না। তাই আমি মনে করি, ১ আগস্টের আগে শুল্ক কমতেও পারে, আবার না-ও পারে।’
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈঠকে যুক্ত থাকা এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে গতকাল বণিক বার্তার কথা হয়। তিনদিনের বৈঠকে অমীমাংসিত বিষয়গুলো কী জানতে চাইলে তিনি উল্লেখযোগ্য তিনটি বিষয়ের কথা জানান। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে চুক্তির রুলস অব অরিজিনের বিষয়টি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পণ্য উৎপাদনে মূল্য সংযোজন বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে দরকষাকষি হয়েছে। এছাড়া অমীমাংসিত অন্য দুই বিষয়ের মধ্যে রয়েছে শ্রম আইন ও তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত।
ঘোষিত ৩৫ শতাংশ শুল্কহারে ১ আগস্টের আগে কোনো পরিবর্তন আসতে পারে কিনা জানতে চাইলে বৈঠকসংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানায়, আসতে পারে। শুল্কের আলোচনাটি দুই লাইনের। বেশ কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করে তারা বলেছিল, এগুলো করো তাহলে শুল্ক কমবে। তবে এ নিয়ে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
আশাবাদের কারণ জানতে চাইলে ওই সূত্র বলেন, আমাদের আর্গুমেন্ট আশার কারণ। আমরা বলেছি যে শুল্ক না কমলে আমাদের সবচেয়ে বড় গন্তব্যে রফতানি কম্পিটেটিভ থাকবে না। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া শর্তের অনেকগুলো মানা হয়েছে। বাকিগুলো মানা হবে না, এমনটা বলা হয়নি। বলা হয়েছে, বিবেচনা করা হবে।
সরকারের দরকষাকষির পদ্ধতিতে নিশ্চয়ই শক্তিশালী কোনো ক্ষেত্র রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের আরো অনেক শক্তিশালী পারস্যুয়েশন প্রয়োজন ছিল। আমরা হয়তো ধরে নিয়েছিলাম, আমাদের কিছুই হবে না। এমন ভাবাটা ভুল হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখনো বলছে তারা দরকষাকষি করবে। সেটার জন্য আমাদের যে প্রস্তুতি থাকতে হবে, তা না হলে এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসাটা কঠিন।’ এ কাজে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন ছিল বলেও মনে করেন এ ব্যবসায়ী নেতা।

ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

Leave a Reply




Contact Us