বিরল খনিজের জন্য চীনের পরিবেশকে বিশাল মাশুল দিতে হয় – The Finance BD
 ঢাকা     রবিবার, ২৪ অগাস্ট ২০২৫, ০৫:২৬ অপরাহ্ন

বিরল খনিজের জন্য চীনের পরিবেশকে বিশাল মাশুল দিতে হয়

  • ০৯/০৭/২০২৫

প্রতি এক টন বিরল খনিজ উত্তোলনে তৈরি হয় প্রায় ২ হাজার টন বিষাক্ত বর্জ্য। বিবিসির অনুসন্ধানে জানা গেছে, বায়ান ওবো ও গানঝৌ অঞ্চলে দেখা মিলেছে তেজস্ক্রিয় বর্জ্যে ভরা কৃত্রিম হ্রদ, দূষিত জলাশয় এবং ভয়াবহ মাটি ও পানির দূষণের। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন ক্যানসার ও জন্মগত ত্রুটির মতো সমস্যার সঙ্গে এসব দূষণের সম্পর্ক রয়েছে। চীনের ইনার মঙ্গোলিয়া প্রদেশের বায়ান ওবো শহরের সীমানায় দাঁড়ালে চোখে পড়ে ধূসর মাটি আর ক্ষতবিক্ষত পাহাড়। অথচ এক সময় এ অঞ্চল ছিল সবুজ তৃণভূমিতে ঢাকা। কয়েক দশকের খননের ফলে যা এখন গভীর খাদে পরিণত হয়েছে। মাটির ওপরের স্তর কেটে সন্ধান করা হচ্ছে আধুনিক জীবনের জন্য অত্যাবশ্যক এক ‘ধনভাণ্ডার’।

বায়ান ওবো ছাড়া আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর জীবন কার্যত অচল হয়ে পড়তে পারে। বায়ান ওবো ও চীনের জিয়াংসি প্রদেশের গানঝৌ শহরে কেন্দ্রীভূত বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিরল খনিজ আহরণ ও পরিশোধন শিল্প। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক বিরল খনিজ এখান থেকেই আহরিত হয়। এই খনিজগুলো ছাড়া চলে না স্মার্টফোন, ব্লুটুথ স্পিকার, কম্পিউটার, টেলিভিশন, বৈদ্যুতিক গাড়ি এমনকি চিকিৎসা যন্ত্রপাতিও। আর এই বিরল ধাতু সংগ্রহ ও পরিশোধনের ক্ষেত্রে চীন তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের বহু বছর আগেই পেছনে ফেলেছে। যা দেশটিকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রবল কৌশলগত সুবিধা এনে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বাণিজ্য ও শুল্ক নিয়ে দর কষাকষিতে এই ‘বিরল খনিজ’ চীনের বড় হাতিয়ার।

তবে এই আধিপত্যের পেছনে চীনকে পরিবেশগত বিপর্যয়ের বিরাট মাশুল দিতে হচ্ছে। প্রতি এক টন বিরল খনিজ উত্তোলনে তৈরি হয় প্রায় ২ হাজার টন বিষাক্ত বর্জ্য। এ বিষয়ে আরো জানতে চীনের দুটি প্রধান বিরল ধাতু খনিকেন্দ্র- বায়ান ওবো ও দক্ষিণাঞ্চলীয় জিয়াংসির গানঝৌ শহরে গিয়েছিল বিবিসি। গণমাধ্যমটির অনুসন্ধানে জানা গেছে, বায়ান ওবো ও গানঝৌ অঞ্চলে দেখা মিলেছে তেজস্ক্রিয় বর্জ্যে ভরা কৃত্রিম হ্রদ, দূষিত জলাশয় এবং ভয়াবহ মাটি ও পানির দূষণের। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন ক্যানসার ও জন্মগত ত্রুটির মতো সমস্যার সঙ্গে এসব দূষণের সম্পর্ক রয়েছে।

চীনা কর্তৃপক্ষ এসব সমালোচনার প্রতি সংবেদনশীল। বিবিসির সাংবাদিকদের গন্তব্যে যাওয়ার পথে তাদের গাড়ি থামিয়ে তিন ঘণ্টা আটকে রাখা হয়, ভিডিও ফুটেজ মুছে দিতে চাপ দেয় অজ্ঞাতপরিচয় এক খনি ব্যবসায়ী। সরকার যদিও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি, তবে সম্প্রতি খনিশিল্পে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। বায়ান ওবোতে চলছে নিয়মিত খনন, যেখানে খোঁজা হচ্ছে নিওডিমিয়াম ও ডিসপ্রোসিয়াম নামের বিরল খনিজ। এই ধাতুগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী চুম্বক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বৈদ্যুতিক গাড়ি, কম্পিউটার হার্ডড্রাইভ থেকে শুরু করে এমআরই মেশিন পর্যন্ত বহু প্রযুক্তিপণ্যে এদের গুরুত্ব অপরিসীম।

কিন্তু এসব আহরণের প্রক্রিয়ায় উন্মুক্তভাবে তোলা হয় টন টন মাটি, যা ছড়ায় ক্ষতিকর ধুলো ও রেডিওঅ্যাকটিভ উপাদান। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায় গত কয়েক দশকে বায়ান ওবো খনি বনাঞ্চল ধ্বংস করে, নদী-লেকে বিষাক্ত পদার্থ ছড়িয়ে কীভাবে বিস্তৃত হচ্ছে। গানঝৌতে, পাহাড়চূড়ার খাড়া ঢালে বসানো হয়েছে কংক্রিটের ‘লিচিং পুকুর’, যেখানে অ্যামোনিয়াম সালফেট, অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইডসহ অন্যান্য রাসায়নিক দিয়ে মাটি থেকে খনিজ পৃথক করা হয়। এসব পুকুর খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকে, যা আশপাশের জমি ও পানিতে রাসায়নিক দূষণ ঘটায়।

২০১২ সালে চীনা সরকার এ খাতে নিয়ন্ত্রণ জোরদার করলেও তার আগেই ঘটে গেছে বিশাল পরিবেশগত ক্ষতি। দীর্ঘমেয়াদি গবেষণায় দেখা গেছে, এই খনন অঞ্চলগুলোতে বন্যপ্রাণীর আবাস ধ্বংস হয়েছে, মাটির ক্ষয় ঘটেছে আর নদীর পানিতে মিশেছে বিপুল রাসায়নিক বর্জ্য। পরিবেশ গবেষক অধ্যাপক জুলি ক্লিংগার বলেন, ‘চীনের এই উন্নয়ন মডেল যে কী পরিমাণ মানবিক ও পরিবেশগত ক্ষতি ডেকে এনেছে, সেটা সত্যিকার অর্থে বোঝা কঠিন।’ বায়ান ওবো খনির দক্ষিণে বাওটো শহরে অবস্থিত ওয়েইকুয়াং বাঁধ ঘিরে সবচেয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এক গবেষণায় দেখা যায়, গ্রামের মানুষদের হাড়ের বিকৃতি, অতিরিক্ত ফ্লোরাইড ও আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার হার অতিরিক্ত মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে। সরকার পরে সেখানকার মানুষদের সরিয়ে নিয়েছে, কিন্তু ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ বিষাক্ত বর্জ্যভরা পুকুর আজও রয়ে গেছে। যার বিষাক্ত পানি যেকোনো সময় মিশে যেতে পারে চীনের অন্যতম প্রধান পানির উৎস হোয়াংহো নদীতে।

ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

Leave a Reply




Contact Us