স্টিভ লং: জার্মান ইউটিউবারের বাংলাদেশে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প – The Finance BD
 ঢাকা     মঙ্গলবার, ০৮ Jul ২০২৫, ০৪:২১ পূর্বাহ্ন

স্টিভ লং: জার্মান ইউটিউবারের বাংলাদেশে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প

  • ২১/০৬/২০২৫

ভক্তদের কাছে স্টিভ লং ‘লম্বা ভাই’ নামেই পরিচিত।
২০১৮ সালে ইউটিউবে একটি ভিডিও দেখে রোহিঙ্গা সংকট সম্পর্কে জানার পর স্টিভ লং আর চুপ থাকতে পারেননি। শরণার্থী ক্যাম্পে সাহায্য করতে ব্যাগ গুছিয়ে জার্মানি থেকে সরাসরি বাংলাদেশে চলে আসেন। বিশ্বের এক কোণে এত বড় মানবিক সংকট চলছে, অথচ জার্মানিতে বসে এ সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতে পারছিলেন না লং। সে সময় লং মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গোপ্রোতে ক্যামেরা বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু জীবনে আরও কিছু অর্থবহ করার তাগিদ আর রোহিঙ্গা সংকট তাকে গভীরভাবে আলোড়িত করে। সেই তাড়নাতেই তিনি শরণার্থী ক্যাম্পে কাজ করতে বাংলাদেশে চলে আসেন।
সেই সময়ের কথা মনে করে লং বলেন, ‘আমার তেমন কোনো প্রাসঙ্গিক যোগ্যতা ছিল না বলে আন্তর্জাতিক কোনো এনজিও আমাকে চাকরি দিচ্ছিল না। তাই আমি এক স্থানীয় এনজিওতে সাক্ষাৎকার দিই এবং সেখানেই খাদ্য প্রস্তুত ও বিতরণের কাজে যোগ দিই।’
সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচিতি
লং বিশ্বাস করতেন, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তার নিজ দেশে আরও সচেতনতা সৃষ্টি হওয়া জরুরি। সে লক্ষ্যেই তিনি ইউটিউব চ্যানেল খুলে ক্যাম্পে ভিডিও করার সিদ্ধান্ত নেন, যেন জার্মানিতে থাকা তার বন্ধুরা সেগুলো দেখে রোহিঙ্গাদের অবস্থার বিষয়ে জানতে পারে এবং আরও মানুষের দৃষ্টি এই সংকটের দিকে যায়। লং বলেন, ‘আমি শুধু গোপ্রোর ক্যামেরা বিক্রি করতাম, ভিডিও ধারণে একেবারেই দক্ষ ছিলাম না। ইউটিউবে শত শত ঘণ্টা ভিডিও দেখে নিজেই ভিডিও শুটিং আর এডিটিং শিখেছি।’
শুরুতে তার ভিডিওগুলো কেবল শরণার্থী ক্যাম্প ঘিরেই ছিল। ভিডিওর মান ও ক্যামেরার কাজ ছিল বেশ অপরিণত, কারণ তখনও তিনি শিখছিলেন। কয়েকটি ভিডিও আপলোডের পর লং লক্ষ্য করেন, জার্মান দর্শকরা তার কনটেন্টে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। বরং ধীরে ধীরে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন। এটা বুঝে তিনি নিজের লক্ষ্য পরিবর্তন করেন এবং বাংলাদেশ ঘুরে বেড়ানোর সাধারণ ট্রাভেল ভ্লগ তৈরি শুরু করেন। লং বলেন, ‘বাংলাদেশে ভিডিও কনটেন্ট যেন নিজে থেকেই তৈরি হয়। রাস্তায় সবসময়ই কিছু না কিছু ঘটে, চারপাশ এতটাই প্রাণবন্ত।’
একটি ট্রাভেল ভ্লগের জন্য লং সিদ্ধান্ত নেন, স্থানীয় এনা বাসে চড়ে তার অভিজ্ঞতা ইউটিউবে শেয়ার করবেন। সেই ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যায়, ৩ লাখেরও বেশি ভিউ পায় এবং বাংলাদেশিদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। লং বলেন, ‘এরপর থেকে ভিডিও বানানো আমি সত্যিই উপভোগ করতে শুরু করি। নতুন নতুন লোকাল খাবার ট্রাই করতাম, বিভিন্ন জায়গায় যেতাম—এই ভাবেই চলছিল।’ তবে লং জানেন, একজন বিদেশি হিসেবে বাংলাদেশে এসে ভিডিও বানালে অনেক সময় লোকজনকে ব্যবহার করে ভিউ বাড়ানোর অভিযোগ উঠতে পারে। এ বিষয়ে তার অবস্থান স্পষ্ট—তিনি খ্যাতি বা টাকার জন্য কাজ করেন না। তিনি বলেন, ‘আমি একজন সাধারণ মানুষ, কোনো বড়লোক বিদেশি না যে দামি গাড়িতে চড়ে সাজানো অভিজ্ঞতা দেখাই।’ তিনি বলেন, ‘আমি সবকিছুই লোকালভাবে করি—লোকাল খাবার খাই, লোকাল বাসে চলাফেরা করি। সিলেট গেলে অন্যদের মতো ৪০০ টাকার এনা বাসে যাই, স্থানীয় রেস্টুরেন্টে গিয়ে বিরিয়ানি খাই।’
ভক্তদের কাছে স্টিভ লং ‘লম্বা ভাই’ নামেই পরিচিত।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি লম্বা বলে কেউ আমাকে “লম্বা” ডাকে না। আমি শুধু বাংলাদেশেই লম্বা, জার্মানিতে এটা স্বাভাবিক উচ্চতা। আসলে আমি যে দেশে থাকি, সে দেশের ভাষা অনুযায়ী আমার শেষ নামটি অনুবাদ করি। যেমন স্পেনে থাকলে আমার নাম হতো “লারগো”, আর এখানে “লং” মানে “লম্বা”।’
বাংলাদেশের প্রথম চিনি-ছাড়া ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংক
শুরুতে ইউটিউব কনটেন্ট তৈরির জন্য লং প্রতিবছর কয়েক সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশে আসতেন, এরপর আবার জার্মানিতে ফিরে যেতেন। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির সময় তিনি কিছুদিন জার্মানিতেই আটকে পড়েন। তবে মহামারি শেষ হওয়ার পর আর দেরি না করে তিনি আবার বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
লং বলেন, ‘কোভিড-১৯–এর পর বাংলাদেশে ফিরে এসে আমাকে ভাবতে হয়—আমি আসলে কী করতে চাই। ইউটিউব ভিডিও বানানো অবশ্যই দারুণ একটা কাজ, কিন্তু সেটি দিয়ে জীবিকা চালানো সম্ভব না।’
তিনি জানান, বাংলাদেশে ইউটিউব ভিডিওতে বিজ্ঞাপনদাতার সংখ্যা খুব কম। তাই এখানকার দর্শকদের ভিউ থেকে আয়ও খুব সামান্য। ফলে দেশে দীর্ঘ সময় থাকতে হলে আয় করার ভিন্ন পথ খুঁজে বের করতেই হতো।
এই ভাবনা থেকেই লং মনোযোগ দেন তার খেলাধুলার প্রতি ভালোবাসার দিকে। জার্মানিতে থাকাকালে তিনি নিয়মিত শরীর চাঙা রাখতে ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংক পান করতেন। কিন্তু বাংলাদেশে এসে এমন স্বাস্থ্যকর পানীয় খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল।
লং বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রায় সবকিছুতেই প্রচুর চিনি থাকে। এমনকি যেসব ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংক সুপারিশ করা হয়, সেগুলোর মধ্যেও অস্বাস্থ্যকর পরিমাণে চিনি থাকে। আমি ইউটিউবে একটা ভিডিও বানিয়ে দেখিয়েছি, সাধারণ ২০০ মিলিলিটারের একটি বোতলে কতটা চিনি থাকে—আমি নিজেই দেখে অবাক হয়েছিলাম!’ তিনি বুঝতে পারেন, শরীরের প্রয়োজনীয় মিনারেল পূরণে একটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প দরকার। এখান থেকেই জন্ম নেয় ‘স্ট্রাইকার’ নামে বাংলাদেশের প্রথম চিনি-ছাড়া ফ্লেভারযুক্ত ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংক। পানীয়ের মান নিয়ে লং কোনো আপস করতে চাননি। কারণ তিনি নিজেই একটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প খুঁজছিলেন এবং নিজেকে জার্মানদের প্রতিনিধি হিসেবে দেখেন। তিনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘যদি কোনো খারাপভাবে পরিচালিত কারখানার ছবি বাইরে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে কেউ আর জার্মানদের বিশ্বাস করবে না!’
তাই লং যে ফর্মুলা বেছে নিয়েছেন, সেটি জার্মান মান অনুযায়ী তৈরি, যাতে রয়েছে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং সোডিয়াম। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘ঘাম ঝরলে শুধু লবণ নয়, শরীর থেকে অন্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজও বেরিয়ে যায়। পটাশিয়াম হৃদ্‌যন্ত্রের জন্য উপকারী, আর ম্যাগনেসিয়াম শরীর পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে। গরমে ঘামা, খাবারে বিষক্রিয়া কিংবা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে এই খনিজগুলো শরীরে ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি।’
স্ট্রাইকারের দাম ঠিক করাও ছিল লংয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেশি হয়। কিন্তু তিনি চেয়েছেন, পানীয়টি যেন সবার সামর্থ্যের মধ্যে থাকে। খরচ কমাতে তিনি এমন একটি পদ্ধতি নেন—যদিও বেশির ভাগ উপাদান বিদেশ থেকে আনা হয়েছে, তবে উৎপাদন ও প্রস্তুতের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে বাংলাদেশেই। লং বলেন, ‘যদি পুরোপুরি জার্মানিতে তৈরি করে বাংলাদেশে আমদানি করতাম, তাহলে প্রতিটি বোতলের দাম হতো প্রায় ৪০০ টাকা। কিন্তু বাংলাদেশে তৈরি করায় এখন ১০০ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব হয়েছে, মানের কোনো ব্যত্যয় ছাড়াই।’
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনি বাংলাদেশে বিভিন্ন উৎপাদন ও প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলেন। শেষ পর্যন্ত ব্রুভানা বেভারেজেসের সঙ্গে অংশীদার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে পণ্য তৈরি করতে সক্ষম।
লং বলেন, ‘আমি এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে চেয়েছিলাম, যাদের রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে স্বচ্ছ সম্পর্ক রয়েছে। আমি স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছিলাম, স্ট্রাইকার কেবল তখনই বাজারে আসবে, যখন এটি সরকারি সব মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে এবং বিএসটিআইসহ অন্যান্য সংস্থার পূর্ণ অনুমোদন পাবে।’ স্বাদ নির্ধারণেও লং গবেষণা করেন। জানতে পারেন, বাংলাদেশিরা আম, তরমুজ ও কমলার স্বাদ পছন্দ করে। তবে তিনি ইউনিক কিছু বানাতে চেয়েছিলেন। তাই তিনটি বিশেষ স্বাদ তৈরি করেন—আম-কমলা, স্ট্রবেরি-তরমুজ ও ব্লু রাস্পবেরি।
পণ্যের প্রচারে লং নিজেই তার ইউটিউব দক্ষতা কাজে লাগান। নিজের ইউটিউব চ্যানেলে একটি গল্প তৈরি করেন—যেখানে দেখা যায়, তিনি স্বাস্থ্যকর পানীয় খুঁজতে গিয়ে শুধু অতিরিক্ত চিনি-মেশানো পানীয় পাচ্ছেন। এরপর সেই পানীয়ের নমুনা জার্মানির একটি ল্যাবে পাঠিয়ে পুরো প্রক্রিয়া ইউটিউবে তুলে ধরেন। বাংলাদেশে ফিরে এসে, তিনি রাস্তায় মানুষের মধ্যে পানীয়ের নমুনা বিতরণ করেন এবং বেশ ইতিবাচক সাড়া পান। লং বলেন, ‘আমি জার্মান প্রস্তুতকারকদের বলেছিলাম—বাংলাদেশিদের জন্য ১০ গুণ বেশি মিষ্টি বানাতে হবে, কারণ এখানকার মানুষ মিষ্টি পানীয়ই পছন্দ করে।’
তবে লংয়ের ফর্মুলায় চিনি নেই—তাতে ব্যবহার করা হয়েছে কৃত্রিম মিষ্টি উপাদান।
জার্মানিতে একটি জনপ্রিয় নীল পানীয় ‘পাওয়ারেড’ অনেকেই পান করেন। তাই লংও বাংলাদেশের জন্য এমন একটি নীল পানীয় তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যখন তিনি সেই পানীয়ের নমুনা বাংলাদেশিদের দেন, অনেকে বলেন, স্বাদটা সিরাপের মতো লাগছে। এতে লং অবাক হয়ে যান। তিনি ভাবতে থাকেন, ‘বাংলাদেশিরা তাহলে কী ধরনের ওষুধ খায়?’ তবে এখনো ওই নীল ফ্লেভারটি লংয়ের প্রিয়। যদিও বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় বাকি দুটি স্বাদ।
মাত্র তিন মাস আগে স্ট্রাইকার বাজারে আসে। শুরুতে ফুডপান্ডার সঙ্গে একটি এক্সক্লুসিভ চুক্তি করা হয়। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল খুব ভালো। এখন পানীয়টি স্থানীয় দোকানেও পাওয়া যাচ্ছে। খুব শিগগিরই একটি ওয়েবসাইট চালু হবে, যেখান থেকে সারা দেশের মানুষ অর্ডার করতে পারবেন।
লং তার ব্র্যান্ডকে স্থানীয় ও বিদেশি পানীয়ের একটি হাইব্রিড হিসেবে দেখেন। তিনি আশা করেন, এটি দুইয়ের মধ্যে একটি সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করবে এবং দেশের স্বাস্থ্যকর ভোগ্যপণ্যের মান আরও উন্নত করবে। অনেকে ১০০ টাকার দাম নিয়ে অভিযোগ করলেও লং মনে করেন, স্বাস্থ্যগত মান ঠিক রাখতে এই দাম যথাযথ।
তিনি বলেন, ‘যখন মানুষ অর্থসংকটে থাকে, তখন এসব বিষয়ে ভাবার সুযোগ পায় না। এমনকি জার্মানিতেও, কয়েক দশক আগেও মানুষ স্বাস্থ্যকর পানীয় নিয়ে ভাবত না—তারা তখন বাসা ভাড়া ও সংসারের খরচ সামলাতে ব্যস্ত থাকত। কিন্তু একবার যখন আপনি একটু স্বচ্ছল হন, তখন প্রতিদিন যা খাচ্ছেন, তা নিয়ে চিন্তা শুরু হয়।’
লং বিশ্বাস করেন, যদি মানুষ বুঝতে পারে যে একটু বেশি দামে ভালো মানের স্থানীয় পণ্য পাওয়া যায়, তাহলে তা বিদেশি ব্র্যান্ডদেরও আকৃষ্ট করবে।
ভবিষ্যতে লং নতুন স্বাদ ও পণ্য আনতে চান। তবে তার শর্ত, সবকিছুই স্বাস্থ্যকরভাবে হতে হবে।
লং বলেন, ‘আমি শিগগিরই এমন একটি অনলাইন স্টোর চালু করতে চাই, যেখান থেকে যারা পানীয় কিনবেন, তাদের সবাইকে আমি ব্যক্তিগত ভিডিও পাঠাব। আমি বাংলাদেশকে স্বাস্থ্যকর একটি দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। আর সে জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হলে তাতেও আমার আপত্তি নেই।’

ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

Leave a Reply




Contact Us