ইসরায়েল-ইরান সংঘাতঃ দুই পক্ষেরই হামলার নিশানায় জ্বালানি তেল ডিপো গ্যাস ক্ষেত্র, বিমানবন্দর – The Finance BD
 ঢাকা     মঙ্গলবার, ০৮ Jul ২০২৫, ০৪:১৮ পূর্বাহ্ন

ইসরায়েল-ইরান সংঘাতঃ দুই পক্ষেরই হামলার নিশানায় জ্বালানি তেল ডিপো গ্যাস ক্ষেত্র, বিমানবন্দর

  • ১৬/০৬/২০২৫

ট্রাম্প-পুতিন ফোনালাপ, রাশিয়ার মধ্যস্থতা করার প্রস্তাবে কমেনি ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাতের তীব্রতা। গতকাল দেশ দুটি একে অন্যের লক্ষ্যবস্তুতে মিসাইল ও বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে শুধু ইরানের পরমাণু বোমা তৈরির প্রক্রিয়াকে দেরি করানো নয়, বরং দেশটির সরকার পরিবর্তনের চেষ্টাও করছে ইসরায়েল। চ্যানেল ফোরটিনে একজন ইসরায়েলি কর্মকর্তা সে রকমই ইঙ্গিতবাহী মন্তব্য করেছেন গতকাল। ট্রাম্প-পুতিন ফোনালাপ, রাশিয়ার মধ্যস্থতা করার প্রস্তাবে কমেনি ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাতের তীব্রতা। গতকাল দেশ দুটি একে অন্যের লক্ষ্যবস্তুতে মিসাইল ও বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে। আল জাজিরাকে মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের সম্মানিত কূটনীতিক ফেলো অ্যালান আইর বলেছেন, ইসরায়েলের জন্য সবচেয়ে ভালো ফলাফল হচ্ছে ইরানের সরকার পরিবর্তন, আর তা না হলে অন্তত বর্তমান সরকারের পতনের চেষ্টা করা।
এদিকে দুজন মার্কিন কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে হত্যায় ইসরায়েলের একটি পরিকল্পনায় সম্প্রতি ট্রাম্প ভেটো দিয়েছেন। ওই কর্মকর্তাদের একজন বলেন, ‘ট্রাম্প বলেছেন, ইরানিরা এখনো কোনো আমেরিকানকে হত্যা করেছে কি? না। তাই আমরা এখনই তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার কথা ভাবছি না।’
তবে সরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জাচি হানেগবি প্রতিবেদনটিকে ‘ভুয়া খবর’ অভিহিত করে তা অস্বীকার করেছেন বলে দ্য টাইমস অব ইসরায়েল জানায়। ইসরায়েলের বার ইলান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মেনাচেম ক্লেইন মনে করেন ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করা নয়, বরং ইরানে সরকার বদলের জন্যই হামলা করছে ইসরায়েল। আল জাজিরাকে তিনি বলেছেন, ‘পরমাণু প্রকল্পের সঙ্গে সম্পর্কহীন এত বেশি টার্গেটে হামলা করা হয়েছে যে আমি আর কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছি না।’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, উভয় পক্ষের একটি চুক্তিতে আসা উচিত। এছাড়া সংঘাত বন্ধে তিনি ফোন ও মিটিং করছেন বলেও জানিয়েছেন ট্রাম্প। কিন্তু এখনো ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাত বন্ধের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এদিকে রোববার রাতে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে আবার ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইরান। সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, ইরান থেকে নতুন করে আরো ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ শনাক্ত করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। তাই ইসরায়েলি নাগরিকদের দ্রুত আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। সিএনএনের সংবাদ কর্মীরা জানিয়েছেন, তেল আবিবে সাইরেন শোনা গেছে এবং বিস্ফোরণের শব্দও পাওয়া গেছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় রয়েছে ও ইরানের হামলা প্রতিহত করার চেষ্টা চলছে। আল জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, ইসরায়েল সব বিমানবন্দর ও আকাশসীমা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ঘোষণা করেছে।
অন্যদিকে ইরানের পশ্চিমাঞ্চলে নতুন করে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। আল জাজিরার খবরে বলা হয়, ইসরায়েলের সেনাবাহিনী দাবি করেছে, ইরানের পশ্চিমাঞ্চলে ‘ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনা’ লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনী এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, যেসব স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছে সেগুলো ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। ইসরায়েলের জাতীয় জরুরি পরিষেবার বরাত দিয়ে আল জাজিরা জানিয়েছে, গতকাল রাতে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় শহর হাইফায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় অন্তত ৪ জন আহত হয়েছেন। রয়টার্স জানিয়েছে, হাইফায় একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়েছে। সেখানে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ইরানের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কমান্ডার আহমাদ আলি জানিয়েছেন, গত ৪৮ ঘণ্টায় ইরানের আকাশসীমায় প্রবেশের চেষ্টা করা ৪৪টি ইসরায়েলি ড্রোন ও কোয়াডকপ্টার গুলি করে নামানো হয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আইআরএনএর বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে আল জাজিরা। এদিকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, ‘আশা করি, আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতি শান্ত হবে এবং আলোচনার পথ খুলবে।’ আল জাজিরার খবরে বলা হয়, মাখোঁ গ্রিনল্যান্ড সফরের সময় এসব কথা বলেন। তিনি জানান, রোববার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত কানাডায় চলমান জি৭ সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে।
এর আগে শনিবার রাতে ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্যাস ক্ষেত্র সাউথ পার্সে। এ গ্যাস ক্ষেত্রে ইরানের সঙ্গে কাতারেরও মালিকানা রয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেছেন, এটা ইসরায়েলের খুবই বিপজ্জনক পদক্ষেপ। তারা যুদ্ধকে ইরানের বাইরেও ছড়িয়ে দিতে চাইছে। ইসরায়েল নিজের দেশে জরুরি অবস্থার মেয়াদ বৃদ্ধি করেছে ৩০ জুন পর্যন্ত। গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স হ্যান্ডলে ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস ফারসি ভাষায় ইরানি নাগরিকদের প্রতি সতর্কবার্তা প্রকাশ করে। বার্তায় যেকোনো অস্ত্র উৎপাদন কারখানা এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আশপাশ থেকে সাধারণ নাগরিকদের সরে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পর স্থানীয় সময় বিকালে তেহরানের আকাশে দেখা দেয় ইসরায়েলের ফাইটার জেট। এ সময় বিমান থেকে বিভিন্ন স্থাপনায় বোমা হামলা করা হয়। বোমা পড়েছে মাশাদ বিমানবন্দরেও। অন্যদিকে একই সময় তেহরানে অন্তত পাঁচটি গাড়িবোমা বিস্ফোরিত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইরানের সংবাদ সংস্থা ইরনা। এ হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করা হয়েছে। এ গাড়িবোমা হামলায় কয়েকজন পরমাণুবিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন বলে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। শুক্রবার ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর থেকে গতকাল পর্যন্ত ইরানের অন্তত ১৪ জন পরমাণুবিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। গতকাল তেহরানের বিভিন্ন স্থানে পানি ও স্যুয়ারেজ পাইপে বিস্ফোরণের কিছু ভিডিও প্রকাশ হয়েছে। যদিও এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো সংবাদমাধ্যম এর সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি।
ইসরায়েলের হামলা ইরানে সরকারের পরিবর্তনের লক্ষ্যে চালিত হলেও বাস্তবে উল্টো ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন তেহরানের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষক আলী আকবর দারানি। আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘আমি এমন জাতীয় ঐক্য সহসা দেখিনি। এমনকি যে ইরানিরা বর্তমান শাসকদের পছন্দ করেন না তারাও বিদেশী হানাদারদের আক্রমণে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ।’ ১৯৮৮ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে এমন সংঘাত আর দেখেনি ইরানের জনগণ। গতকাল ইরানের সরকার জানিয়েছে, দ্রুতই মেট্রো স্টেশন, স্কুল ও মসজিদকে ইসরায়েলি হামলার সময় আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে। এজন্য স্কুল ও মসজিদে বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরির কাজ চলছে। গতকাল পর্যন্ত ইসরায়েল ইরানে ২৫০টি স্থানে বিমান হামলা চালিয়েছে। তাদের লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে ছিল ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তর, সামরিক গবেষণা ও উন্নয়ন শাখা। সেই সঙ্গে দুটি ‘দ্বৈত ব্যবহারের’ জ্বালানি কেন্দ্র। ওই জ্বালানি কেন্দ্র সামরিক ও পারমাণবিক কাজে ব্যবহার হতো।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বেশকিছু ভিডিওতে দেখা যায়, ইরানের রাজধানী তেহরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটি তেল ডিপোতে ভয়াবহ আগুন লেগেছে। ভিডিওতে দুজন স্থানীয় বাসিন্দাকে দেখা যায়, যারা তেহরানের উত্তর-পশ্চিমে সাইমন বলিভার স্ট্রিট থেকে শাখরান তেল ডিপোর আগুন দেখতে পাচ্ছেন। আরেকটি ভিডিও ক্লিপও সাইমন বলিভার স্ট্রিট থেকে ধারণ করা। এতে দেখা যায়, একটি তেলবাহী ট্যাঙ্কার জ্বলছে এবং এক ব্যক্তি ভিডিও ধারণের সময় স্থান ও সময় নিশ্চিত করছেন।
অন্যদিকে শনিবার রাতভর ইরানের হামলায় ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় শহর হাইফার একটি তেল শোধনাগার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশটির ছোড়া ৮০টি ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে ৪০টি আঘাত হেনেছে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে। এ অঞ্চলেই হাইফা অবস্থিত। ইরান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর একটি ভিডিওতে দেখা যায়, হাইফা তেল শোধনাগারের কাছে আগুন জ্বলছে। ভিডিওটি দূর থেকে ধারণ করা হলেও আশপাশের পরিচিত ল্যান্ডমার্কের সঙ্গে মিলিয়ে এবং সঠিক লোকেশন চিহ্নিত করে বোঝা যায় এটি তেল শোধনাগারের কাছ থেকেই ধারণ করা হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত ইরানের মিসাইল হামলায় অন্তত ১৪ ইসরায়েলির মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে তিনদিনের ইসরায়েলি হামলায় নিজের ১২৮ জন নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে ইরান। ইরানের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কমান্ডার আহমেদ আলী গৌদারজি বলেছেন, ইরানের সীমান্ত ইউনিটগুলো গত ৪৮ ঘণ্টায় ৪৪টি ইসরায়েলি ড্রোন এবং কোয়াডকপ্টারকে দেশের আকাশসীমায় প্রবেশ করতে বাধা দিয়েছে।
গতকাল রাতে প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে গ্রিনল্যান্ড সফররত ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ আশা প্রকাশ করেছেন ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাত শিগগিরই শান্ত হয়ে আসবে। এদিকে উত্তেজনা কমাতে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনায় মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেন। আবার ইরানে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে সৌদি আরব, বাহরাইন, মরক্কো, ওমান, কাতার, কুয়েতের মতো পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো। তবে এখনো বিবৃতির বাইরে ইসরায়েলকে থামাতে তাদের কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ দেখা যায়নি। জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোহান ওয়েডেফুল বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য সফরে রয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান সংঘাতে উত্তেজনা কমাতে সহায়তা করার জন্য তিনি কাজ করছেন। তিনি আরো বলেন, ‘আমি আশা করি এটি এখনো সম্ভব। ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সঙ্গে প্রস্তুত রয়েছে জার্মানি। আমরা ইরানকে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে তাৎক্ষণিক আলোচনার প্রস্তাব দিচ্ছি, আমি আশা করি এ প্রস্তাব গৃহীত হবে।’
গতকাল ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি বলেছেন, ইসরায়েল তাদের সামরিক আগ্রাসন বন্ধ করলে আমরাও আর জবাব দেব না। তিনি বলেন, ‘আমরা আত্মরক্ষা করছি। আমাদের এটা করা পুরোপুরি যুক্তিযুক্ত। এটাই তাদের (ইসরায়েল) আগ্রাসনের বিপরীতে আমাদের জবাব। যদি তারা সামরিক আগ্রাসন বা হামলা বন্ধ করে, তাহলে আমাদের জবাবও বন্ধ হয়ে যাবে।’

ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

Leave a Reply




Contact Us