আগ্রাসী আরাকান আর্মি, উপস্থিতি জোরদার মিয়ানমার জান্তার।
মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে সামরিক জান্তাবিরোধী সংঘাত নতুন মাত্রা পেয়েছে, যার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী কিয়াকফিউ। মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে সামরিক জান্তাবিরোধী সংঘাত নতুন মাত্রা পেয়েছে, যার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী কিয়াকফিউ। গুরুত্বপূর্ণ এ শহর দখলে আরাকান আর্মি আগ্রাসী হয়ে উঠছে। বিপরীতে তাদের ঠেকাতে এরই মধ্যে এ অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করছে মিয়ানমার জান্তা; বাড়িয়েছে সৈন্য, অস্ত্রসহ সামরিক সরঞ্জামের মজুদ। সব মিলিয়ে রক্তাক্ত যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নিচ্ছে কিয়াকফিউ, যা শুধু সামরিক বা রাজনৈতিক নয়; ভূরাজনৈতিক স্বার্থ ও আঞ্চলিক শক্তির লড়াইয়েরও কেন্দ্রবিন্দু।
রাখাইনের যে তিনটি ঘাঁটি এখনো সামরিক জান্তার দখলে রয়েছে তার একটি কিয়াকফিউ। চীনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল এটি। এখানকার মাদেই দ্বীপের গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প চীনের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এ অঞ্চল বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের প্রাণকেন্দ্র। কিয়াকফিউ থেকেই শুরু হয়েছে মিয়ানমার-চীন পাইপলাইন, যা ইউনান প্রদেশ পর্যন্ত গ্যাস ও অপরিশোধিত তেল পরিবহন করে। চীন এ পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি আমদানির জন্য মালাক্কা প্রণালির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প পথ নিশ্চিত করেছে। এখানকার গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র, অনশোর টার্মিনাল ও অন্যান্য অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিশাল চীনা বিনিয়োগ রয়েছে। কিয়াকফিউ চীন ও ভারতের কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্র হিসেবেও বিবেচিত।
সব মিলিয়ে কিয়াকফিউ শহরটি শুধু মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের অংশ নয়, বরং চীনের কৌশলগত স্বার্থরক্ষার লড়াইয়েরও প্রতীক। আরাকান আর্মির অগ্রগতি ও শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছে যাওয়া বেইজিংকে উদ্বিগ্ন করেছে। সূত্রমতে, চীনা বিনিয়োগ রক্ষায় এরই মধ্যে প্রাইভেট সিকিউরিটি সার্ভিসেস আইনের আওতায় প্রায় ৫০ জন চীনা নিরাপত্তাকর্মী কিয়াকফিউতে মোতায়েন রয়েছেন। পাশাপাশি আরাকান আর্মি দাবি করেছে, জান্তা সরকার চীনের সরবরাহকৃত ড্রোন ও কারিগরি সহায়তার সাহায্যে তাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আরাকান আর্মি কিয়াকফিউ দখলের মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিকে বড় পদক্ষেপ নিতে চায়। শহরটি দখলে গেলে আরাকান আর্মি শুধু রাখাইনের দক্ষিণাংশের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণই পাবে না, বরং চীনের সঙ্গে আলোচনার জন্য সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। অর্থনৈতিক কাঠামো, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে এটি তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হতে পারে।
আরাকান আর্মি এরই মধ্যে রাখাইনের ১৭টির মধ্যে ১৪টি টাউনশিপ দখলে নিয়েছে। কিয়াকফিউ, সিত্তে ও মুনাউং—তিনটি শহরই কেবল জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণে। কিয়াকফিউ দখল মানে উপকূল ও আন্তর্জাতিক সংযোগের দিক থেকে জান্তা সরকারের পতনকে আরো ত্বরান্বিত করা। অন্যদিকে টাউনশিপটি রক্ষায় জান্তা সেনারা বিভিন্ন ব্যাটালিয়নে ছড়িয়ে আছে। ডান্যাওয়াডি নৌঘাঁটি, লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন ৫৪২ ও ৫৪৩, ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন ৩৪ ও পুলিশ ব্যাটালিয়ন ৩২-এ উপস্থিতি আরো শক্তিশালী করছে জান্তা সরকার। গত মাসে এগুলোয় বারবার রসদ, অস্ত্র ও সেনা পাঠানো হয়েছে। যদিও নতুন সৈন্যদের বড় অংশই জোরপূর্বক নিযুক্ত এবং প্রশিক্ষণহীন, যা জান্তার প্রতিরোধক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।
স্থানীয় খবরে জানা গেছে, ডান্যাওয়াডি নৌঘাঁটিতে অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে জান্তা সেনারা। তদের সঙ্গে আশপাশের অন্যান্য ইউনিটের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এ ঘাঁটির আশপাশেই রয়েছে আরো দুটি নৌ-সামরিক স্থাপনা। চীনের বিনিয়োগকেন্দ্রিক বিভিন্ন স্থাপনা, যেমন—গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও অনশোর গ্যাস টার্মিনাল-সংলগ্ন এলাকায় সেনাবাহিনীর অতিরিক্ত সৈন্য, অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও খাদ্য সরবরাহ পাঠিয়েছে।
যুদ্ধক্ষেত্র-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, এলাকায় নিয়মিত গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। তবে আরাকানি আর্মি এখনো কিয়াকফিউতে পুরোদমে আক্রমণ শুরু করেনি। জান্তা বাহিনী ড্রোন ও প্যারামোটরের মাধ্যমে আরাকানি আর্মি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বোমা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। আরাকান আর্মির সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো দাবি করছে, এ আধুনিক ড্রোন প্রযুক্তি ও চালনায় চীনের প্রত্যক্ষ সহায়তা রয়েছে। তাদের মতে, চীন কেবল ড্রোন সরবরাহ করছে না, চালানোর প্রশিক্ষণও দিচ্ছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জান্তা সরকার একটি বিতর্কিত ‘প্রাইভেট সিকিউরিটি সার্ভিসেস আইন’ পাস করে, যার মাধ্যমে চীনা বেসরকারি নিরাপত্তা বাহিনী মিয়ানমারে চীনের বিনিয়োগ প্রকল্প সুরক্ষার অনুমতি পায়। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ কিয়াকফিউতে অন্তত ৫০ জন চীনা নিরাপত্তাকর্মী পৌঁছেছেন।
আরাকান আর্মি এরই মধ্যে কিয়াকফিউ টাউনশিপের দক্ষিণাংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, যা রামরি টাউনশিপের সীমানা ঘেঁষা। রাখাইনভিত্তিক এক সামরিক বিশ্লেষক বলেন, ‘মনে হচ্ছে আরাকান আর্মি জান্তা নিয়ন্ত্রিত শহরগুলো, বিশেষ করে কিয়াকফিউ ও সিত্তে দখলের চেষ্টায় রয়েছে।’
দুই পক্ষের এমন অবস্থানের মধ্যে কিয়াকফিউ টাউনশিপে এরই মধ্যে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আশ্রয়হীন মানুষের মধ্যে মশারি, পোশাক ও খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। মৎস্য আহরণ ও বনজ সম্পদ সংগ্রহও বন্ধ হয়ে গেছে। জান্তা সেনারা মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছে। বনাঞ্চলে ল্যান্ডমাইন পুঁতে রেখেছে। এছাড়া শহরে ঢোকার ও বের হওয়ার সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে জান্তা বাহিনী। চিকিৎসা নিতে হলে স্থানীয়দের ঘুস দিয়ে শহরে প্রবেশ করতে হচ্ছে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিও দুর্গত জনগণের কষ্ট আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
এ পরিস্থিতিতে চীন একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। বেইজিং একদিকে জান্তা সরকারের সঙ্গে তাদের গভীর সখ্য বজায় রেখেছে, অন্যদিকে আরাকান আর্মির মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বিকল্প চ্যানেলও প্রস্তুত করছে। মিয়ানমার সামরিক জান্তা ও আরাকান আর্মি—দুপক্ষই জানে কিয়াকফিউ যার দখলে থাকবে তারাই চীনের সঙ্গে অধিকতর সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। ফলে সার্বিকভাবে কিয়াকফিউ এখন শুধু একটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যুদ্ধ নয়; এটি একটি ভূরাজনৈতিক টানাপড়েনের লড়াইও।
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন