২০১৯ সালের গ্রীষ্মে যুক্তরাজ্যজুড়ে বড় ধরনের বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দেয়। এর কয়েক সেকেন্ড পরই উত্তর ওয়েলসের ডিনরউইগ হাইড্রোপাওয়ার প্লান্টের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বেজে ওঠে ফোন। ফোনের ওপারে ছিলেন দেশটির জ্বালানি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রক। জাতীয় গ্রিড যেন সম্পূর্ণ ভেঙে না পড়ে, তা নিশ্চিত করতে জরুরি ভিত্তিতে ব্যাপক মাত্রার বিদ্যুৎ সরবরাহের অনুরোধ করেছিলেন তিনি। ডিনরউইগ থেকে দ্রুত সাড়া মেলে। শেষ পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ মানুষ অল্প সময়ের জন্য বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন থাকলেও ওই ফোনকলের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় হয়তো যুক্তরাজ্যের এক দশকের সবচেয়ে ভয়াবহ ব্ল্যাকআউটকে আরো বড় বিপর্যয়ে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করেছিল। এরপর গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা অনেক হালনাগাদ হয়েছে। তা সত্ত্বেও জলবিদ্যুতের মতো পুরনো প্রকৌশলকে ভবিষ্যৎ ব্ল্যাকআউটের উপশম হিসেবে ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা।
ডিনরউইগ ও ইরিরি জাতীয় উদ্যানের সীমান্তে সিস্টার প্রজেক্ট ফেস্টিনিয়গ এখন বড় ধরনের আধুনিকায়নের পথে রয়েছে। দুই হাইড্রোপাওয়ার প্রকল্পের মালিকেরা ১০ বছর মেয়াদে এক বিলিয়ন পাউন্ড পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে যাচ্ছেন। যাতে আরো কয়েক দশক ধরে এ ‘নীরব ত্রাণকর্তারা’ নির্ভরযোগ্য ও পরিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে পারে। ১৯৬৩ সালে যুক্তরাজ্যের প্রথম পাম্পড হাইড্রোইলেকট্রিক সিস্টেমগুলোর একটি হিসেবে চালু হয় ফেস্টিনিয়গ, ১৯৮৪ সালে শুরু হয় ইউরোপের সবচেয়ে বড় ও যেকোনো বিপর্যয়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখানো পাম্পড স্টোরেজ প্লান্ট—ডিনরউইগ। এখন সংস্কার প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভবিষ্যতের জন্য এ দুই প্লান্ট রয়ে যাবে বৃহৎ ব্যাটারির মতো, যেখানে বাড়তি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সংরক্ষণ করা যাবে এবং প্রয়োজন হলে তা দ্রুত ছাড়াও যাবে।
ডিনরউইগের অন্যতম মালিক, ফরাসি জ্বালানি কোম্পানি অ্যাংজির যুক্তরাজ্য শাখার প্রধান মিয়া পাউলুচ্চি বলেন, ‘একই স্কেলের নতুন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে যা খরচ হতো, তার এক-তৃতীয়াংশ ব্যয়ে আমরা ডিনরউইগকে আরো ২৫ বছর বাঁচিয়ে রাখতে পারছি। এটি পুরোপুরি স্বাভাবিক ও বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত।’ যুক্তরাজ্যে প্রথম জলবিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় ১৮৭৮ সালে। নর্থাম্বারল্যান্ডের ক্র্যাগসাইড ম্যানর হাউজে তখন ১০০ মিটার উঁচু থেকে পানির পতনের মাধ্যমে সিমেন্সের জেনারেটর ঘুরিয়ে আর্ক ল্যাম্প চালানো হয়। সে ধারাবাহিকতায় ডিনরউইগ ও ফেস্টিনিয়গ এখনো সেই পুরনো নীতি, অর্থাৎ মাধ্যাকর্ষণ ও প্রবাহিত পানির শক্তি কাজে লাগিয়ে মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই প্রায় ২০ লাখ ঘরের চাহিদা পূরণে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। বিদ্যুৎ সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলে নিচের জলাধার থেকে ওপরের বাঁধে পানি তোলা হয়। পরে চাহিদা বাড়লে সে পানি নিচে নামিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়।
স্থানীয়ভাবে ‘মাইনিদ গোয়েফ্রু’ নামে পরিচিত ডিনরউইগ মাত্র ৭৫ সেকেন্ডের মধ্যে কার্যক্ষম হয়ে ওঠে। ৫০০ মিটার লম্বা বিশাল একটি খাড়া সুড়ঙ্গে প্রতি সেকেন্ডে ৮৬ হাজার গ্যালন পানির স্রোত বইয়ে দেয়া হয়। এ পানি আঘাত করে ৫০০ টন ওজনের ছয়টি টারবাইনে—সেগুলো তখন প্রবল বেগে বিশাল মাত্রায় নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। পুরো যুক্তরাজ্যে বিদ্যুৎ চাহিদার মাত্র ২ শতাংশ জলবিদ্যুৎ দিয়ে পূরণ হলেও এ অল্প পরিমাণই চূড়ান্ত মুহূর্তে সবচেয়ে কার্যকর। বড় বড় জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো তাৎক্ষণিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেলেও জলবিদ্যুতে নেই কার্বন নিঃসরণ।
বাতাস না থাকলে উইন্ড টারবাইন ঘোরে না, সূর্য না উঠলে সৌর প্যানেল বিদ্যুৎ দেয় না। কিন্তু জলবিদ্যুৎ ঠিক সময়মতো কাজে লাগানো যায়। পাশাপাশি এর ঘূর্ণায়মান জেনারেটরগুলো জাতীয় গ্রিডে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করে। ৫০ হার্টজ ফ্রিকোয়েন্সি ধরে রাখা গেলে বিদ্যুৎ বিভ্রাট এড়ানো সম্ভব। এমনকি ব্ল্যাকআউটের পর পুরো বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারেও সাহায্য করতে পারে জলবিদ্যুৎ।
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন