পশ্চিমা দেশগুলোর আশঙ্কা, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার লক্ষ্যে নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। তবে তেহরান বরাবরই দাবি করে আসছে—তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বেসামরিক উদ্দেশ্যপ্রসূত এবং শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চিকিৎসা খাতে ব্যবহারের জন্যই পরিচালিত হচ্ছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনুষ্ঠিতব্য চতুর্থ দফার পারমাণবিক আলোচনা শুরুর আগে সৌদি আরব ও কাতারে সফর করেছেন। এই আলোচনা আজ রোববার (১১ মে) ওমানে অনুষ্ঠিত হবে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ভবিষ্যত দিকনির্দেশনা, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার—এই তিনটি বিষয়ই আলোচনার প্রধান কেন্দ্রে রয়েছে। গতকাল শনিবার দোহায় এক বিবৃতিতে আরাগচি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানকে তার পারমাণবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চায়, তবে তেহরান তার অধিকার থেকে এক চুলও সরবে না।’ ইরানের দাবি, তাদের পরমাণু কর্মসূচি সম্পূর্ণরূপে বেসামরিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত। কোনো ধরনের পরমাণু অস্ত্র অর্জনের উদ্দেশ্য ইরানের নেই। দোহায় আল জাজিরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে আরাঘচি বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি—যদি কোনো চুক্তির মূল উদ্দেশ্য হয় নিশ্চিত করা যে, ইরান কখনো পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করবে না, তবে সেটি তো ইতোমধ্যেই নিশ্চিত—এবং এই অবস্থায় একটি চুক্তি খুব সহজেই সম্ভব।’ ‘কিন্তু অপরপক্ষ যদি কোনো অযৌক্তিক দাবি তোলে, তাহলে অবশ্যই জটিলতা তৈরি হবে,’ যোগ করেন তিনি। ইরানের পরমাণু আলোচনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ আজ ওমানে আলোচনায় অংশ নেবেন। গত শুক্রবার (৯ মে) এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র চায় না—ইরানের এমন দাবি যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে। তবে এই অবস্থান যাচাই করতে ওয়াশিংটন কিছু শর্ত রেখেছে।
তিনি বলেন, ‘যদি ইরান সত্যিই এভাবে চায়, তবে তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করতে হবে, সেন্ট্রিফিউজগুলো অপসারণ করতে হবে এবং পুরো কর্মসূচিকে বেসামরিক প্রকল্পে রূপান্তরিত করতে হবে।’ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ইরানের বেসামরিক জ্বালানি খাতে বিদেশ থেকে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম আমদানির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। শনিবার মধ্যপ্রাচ্য সফরে আরাগচি বলেন, শুক্রবার তেহরান চতুর্থ দফা বৈঠকের বিষয় নিশ্চিত করেছে। ইরানি রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে তিনি বলেন, ‘আলোচনার অগ্রগতি হচ্ছে, এবং যত স্বাভাবিকভাবেই এগোবে, তত বেশি পরামর্শ ও পর্যালোচনার প্রয়োজন হবে।’ এদিকে ওমানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ বাদর আলবুসাইদি গত শুক্রবার জানান, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয়ের পর বিলম্বিত বৈঠকটি মাসকটে অনুষ্ঠিত হবে। গত ৩ মে রোমে বৈঠকটি হওয়ার কথা থাকলেও ‘লজিস্টিক কারণে’ তা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে জানায় ওমান।
পারমাণবিক কর্মসূচি ঘিরে দীর্ঘদিনের বিরোধ
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উত্তেজনা চলছে। এই প্রেক্ষাপটে ওমানে অনুষ্ঠেয় আলোচনাকে বহু বছরের কূটনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে আবারও সংলাপের টেবিলে ফেরার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের একের পর এক প্রশাসন ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন থেকে বিরত রাখতে সচেষ্ট ছিল। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে ২০১৫ সালে ‘জয়েন্ট কমপ্রেহেনসিভ প্ল্যান অব একশন’ (জেসিপিওএ) নামের একটি বহুপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই বহুপাক্ষিক চুক্তির আওতায় ইরান তার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম হ্রাস ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে সম্মত হয়। এর বিনিময়ে তেহরানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাও কিছুটা শিথিল করা হয়। তবে ওবামার পর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে একতরফাভাবে পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরিয়ে নেন। এর ফলে জেসিপিওএ কার্যত ভেঙে পড়ে এবং তেহরানের সঙ্গে পশ্চিমাদের সম্পর্কেও নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পশ্চিমা দেশগুলোর আশঙ্কা, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার লক্ষ্যে নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। তবে তেহরান বরাবরই দাবি করে আসছে—তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বেসামরিক উদ্দেশ্যপ্রসূত এবং শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চিকিৎসা খাতে ব্যবহারের জন্যই পরিচালিত হচ্ছে।
নিজ প্রশাসনের ইরান নীতিতে বিভাজনের কথা স্বীকার করেছেন ট্রাম্প নিজেও। দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতে তিনি বলেন, কিছু উপদেষ্টা তেহরানের ওপর আরও চাপ বাড়ানোর পক্ষে থাকলেও, তিনি কূটনৈতিক সমাধানকেই বেশি প্রাধান্য দিতে চেয়েছিলেন। রেডিও উপস্থাপক হিউ হিউইটকে বৃহস্পতিবার দেওয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন ‘সামরিক পদক্ষেপের চেয়ে আমি চুক্তি করতে বেশি আগ্রহী।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে শুধু দুটি বিকল্প—হয় সুন্দরভাবে ধ্বংস করা, অথবা নির্মমভাবে ধ্বংস করা।’
উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক
সৌদি আরব ও কাতার সফর নিয়ে আরাগচি বলেন, এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল পারমাণবিক ইস্যু নিয়ে উদ্বেগ এবং পারস্পরিক স্বার্থ নিয়ে আলোচনা করা। তিনি জানান, ‘আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে বিষয়টি সবাই বোঝে এবং এতে কোনো উদ্বেগ থাকবে না। আশা করি, একটি চুক্তি হলে এতে সবাই সহমত হবে।’ শনিবার আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সৌদি আরবের নিয়মিত আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখে, তবে এবারের সফরের উদ্দেশ্য ছিল—আসন্ন ইরান-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা বিষয়ে আমাদের সৌদি সহকর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ করা।’ ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এসমাইল বাঘাইই নিশ্চিত করেছেন যে, বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত ইরানের একটি প্রতিনিধিদল এই আলোচনায় অংশগ্রহণ করবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল সম্পর্কে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন