বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির বড় একটি অংশ নিম্নমধ্যম ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের ওপর নির্ভর। গত কয়েক দশকে এসব দেশের অর্থনীতি ক্রমবর্ধমান হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। তা সত্ত্বেও এসব দেশের উচ্চ আয়ের স্তরে উত্তরণে চ্যালেঞ্জ কম নয় বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এর পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ আন্তর্জাতিক সংস্থা জানিয়েছে, চীন, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ শতাধিক দেশ মধ্যম আয়ের ফাঁদে আটকে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই প্রবৃদ্ধির চলমান ধারা বদলাতে দেশগুলোকে আমূল পরিবর্তনের কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থার প্রতিবেদনে উদীয়মান অর্থনীতির দেশের সঙ্গে মার্কিন জীবনযাত্রার মানের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে, অর্থনৈতিক কৌশলে পরিবর্তন না করে প্রবৃদ্ধির জন্য শুধু বিনিয়োগের ওপর নির্ভর করলে আয়ের ব্যবধান কমবে না।
বিশ্বব্যাংক ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট’ প্রতিবেদনে বলছে, গত ৫০ বছরের শিক্ষা হলো যে দেশগুলোর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়েছে, তারা আগের চেয়ে ধনী হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে একটি ফাঁদের মুখে পড়ে গেছে। মধ্যম আয়কে লক্ষ্য করে এগোনো দেশগুলোর মাথাপিছু আয় মার্কিন গড় স্তরের প্রায় ১০ শতাংশ বা ৮ হাজার ডলারের সমান।
পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ১৯৯০ সাল থেকে মাত্র ৩৪টি মধ্যম আয়ের অর্থনীতি উচ্চ আয়ের অবস্থানে যেতে পেরেছে। এসব দেশের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নে একীভূত হওয়ার সুবিধা পেয়েছে অথবা নতুন আবিষ্কৃত জ্বালানি তেলের খনি তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দিয়েছে।
চলমান ধারার প্রবৃদ্ধি উদীয়মান দেশগুলোকে মাথাপিছু আয়ের নিরিখে বেশি দূর এগিয়ে নিতে পারবে না বলে জানান বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ইন্দরমিত গিল। তিনি বলেন, ‘বর্তমান প্রবণতা অনুযায়ী মাথাপিছু আয় মার্কিন স্তরের ২৫ শতাংশে উন্নীত হতে চীনের ১০ বছর ও ভারতের ৭৫ বছর সময় লাগবে।’
তিনি আরো জানান, মধ্যম আয়ের দেশগুলোর ওপর বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করছে। তবে এ দেশগুলোর মধ্যে অনেকগুলো হয় একা বিনিয়োগের ওপর খুব বেশি নির্ভর করে অথবা খুব দ্রুত কৌশল উদ্ভাবনের দিকে চলে যায়, যা তাদের উন্নত অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার পথে বাধা দিতে পারে।
ইন্দরমিত গিল বলেন, ‘প্রবৃদ্ধির জন্য একটি নতুন পদ্ধতির প্রয়োজন হবে। প্রথমে বিনিয়োগের ওপর মনোযোগ দিন, এরপর বিদেশ থেকে নতুন প্রযুক্তির গ্রহণের ওপর জোর দিন এবং অবশেষে একটি ত্রিমুখী কৌশল গ্রহণ করুন যা বিনিয়োগ, প্রযুক্তি গ্রহণ ও উদ্ভাবনের ভারসাম্য বজায় রাখে। জনসংখ্যা, পরিবেশ ও ভূরাজনৈতিক ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে ভুলের কোনো জায়গা নেই।’
২০২৩ সালের শেষ দিকে ১০৮টি দেশকে মধ্যম আয়ের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে বিশ্বব্যাংক। এ দেশগুলোর মাথাপিছু বার্ষিক আয় ১ হাজার ১৩৬ থেকে ১৩ হাজার ৮৪৫ ডলারের মধ্যে ছিল।
মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় ৬০০ কোটি মানুষের বাস অর্থাৎ বিশ্ব জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ। এখানে প্রতি তিনজনের মধ্যে দুজন মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে। এ দেশগুলো বৈশ্বিক জিডিপিতে ৪০ শতাংশের বেশি অবদান রাখে ও ৬০ শতাংশের বেশি কার্বন নিঃসরণের উৎস। বিশ্বব্যাংকের মতে, মধ্য আয়ের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে পূর্বসূরিদের তুলনায় অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে বর্তমান প্রজন্ম। দ্রুত বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধি, উন্নত অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান সুরক্ষাবাদ ও জ্বালানির উৎসের নতুন রূপান্তরের সঙ্গে তাদের লড়তে হচ্ছে।
ইন্দরমিত গিলের মতে, এসব দেশের জন্য মধ্যম আয়ের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হবে। তিনি বলেন, ‘এটা সহজ হবে ভাবার জন্য আমরা যথেষ্ট নির্বোধ নই। মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে অসম্ভবকে সম্ভব করতে হবে। শুধু উচ্চ আয়ের স্থিতিতে নিজেদের উন্নীত করতে নয় বরং পরিবেশ ধ্বংসকারী কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধির পথ থেকে দূরে সরে যেতে হবে।’
মধ্যম আয়ের এ ফাঁদ থেকে মুক্তির জন্য বিশ্বব্যাংক দেশগুলোর জন্য তিন স্তরের কৌশল প্রস্তাব করছে। এর প্রথম পর্যায়ে নিম্ন আয়ের দেশগুলো শুধু বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য পরিকল্পিত নীতিগুলোর ওপর মনোযোগ দিতে পারে। একবার নিম্নমধ্যম আয়ের স্থিতিতে পৌঁছে গেলে, তাদের কৌশল পরিবর্তন করতে হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদের উচিত হবে হালনাগাদ প্রযুক্তি গ্রহণ ও তা সমগ্র অর্থনীতিতে ছড়িয়ে দেয়া। এরপর উচ্চমধ্যম আয়ের স্তরে যেতে চূড়ান্ত বিনিয়োগ, বিদেশী প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও নিজস্ব উদ্ভাবনের সংশ্লেষণ ঘটাতে হবে।
Source : The Gerdian
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন