২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৩৬ বছরে সর্বনিম্ন: বিশ্বব্যাংক – The Finance BD
 ঢাকা     বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ১২:৫১ পূর্বাহ্ন

২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৩৬ বছরে সর্বনিম্ন: বিশ্বব্যাংক

  • ২৬/০৪/২০২৫

ঢাকায় নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আলোড়ন তুলেছে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক পূর্বাভাস। সংস্থাটি জানিয়েছে, আগামী ৩০ জুন শেষ হতে চলা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে আসবে মাত্র ৩.৩ শতাংশে, যা গত ৩৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অথচ মাত্র চার মাস আগেই, জানুয়ারিতে বিশ্বব্যাংক ৪.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আশা করেছিল। তবে বিনিয়োগ কমে যাওয়া, এখনো বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি, আর্থিক খাতে দুর্বলতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে সেই আশাবাদও মলিন হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসের এই অবনমন শুধু একাডেমিক সমন্বয় বলে ধরে নেওয়ার অবকাশ নেই, বরং একইসঙ্গে এটি নির্মম সতর্কবার্তাও বটে।

কারণ মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রতিটি শতাংশের হার— দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবিকানির্বাহের কাহিনিও তুলে ধরে।  আর সেই মানবিক গল্পটাই বাংলাদেশে গাঢ় অন্ধকারে চাপা পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

@দারিদ্র্য বাড়ছে, গভীর হচ্ছে অর্থনৈতিক সংকট

বিশ্বব্যাংকের ‘ম্যাক্রো পোভার্টি আউটলুক’, যা বুধবার সাউথ এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আপডেটের অংশ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে— ২০২৩-২৪ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের কবলে পড়তে পারে, যাদের দৈনিক আয় ২.১৫ ডলারের নিচে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, “উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও কর্মসংস্থান হ্রাস— বিশেষ করে নিম্নআয়ের পরিবারের কল্যাণে বড় আঘাত হেনেছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে প্রায় ৪ শতাংশ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন, এবং স্বল্প দক্ষ কর্মীদের মজুরি ২ শতাংশ ও উচ্চ দক্ষদের ০.৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।”

এতে চরম দারিদ্র্যের হার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ৭.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৯.৩ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। ফলে অর্থনৈতিক দৈন্যতায় পড়বে আরও ৩০ লাখ মানুষ।

বিশ্বব্যাংক জানায়, আয় বৈষম্য আরও বাড়বে বলে অনুমান করা হচ্ছে, যা বিগত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে ঊর্ধ্বমুখী। জিনি সূচকে প্রায় ১ পয়েন্ট বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে, তবে প্রবাসী আয় পাওয়া পরিবারগুলোতে তা কিছুটা কম হবে। এছাড়া অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের চাপ সামলাতে ৫টির মধ্যে ৩টি পরিবার তাদের সঞ্চয় ভেঙে জীবন চালাতে বাধ্য হবে”- এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করা হয়েছে।

জিনি (কেউ কেউ গিনিও বলেন) সহগ। মূলত এটি বৈষম্য মাপার একটি পদ্ধতি। এটি একটি অনুপাত বা ভগ্নাংশ আকারে প্রকাশ করা হয়, যার মান ০ থেকে ১-এর মধ্যে হয়। সবার আয় সমান হলে জিনি সূচক হবে শূন্য। এর অর্থ হলো চরম সাম্য অবস্থা বিরাজ করছে। আর সব আয় একজনের হাতে গেলে সূচকটি হবে ১। এটি আবার চরম অসাম্য অবস্থা। এই দুই সীমার মধ্যে সূচক যত বাড়ে, অসাম্য তত বেশি।

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বৈশ্বিক ঝুঁকির প্রভাবও পড়বে প্রবৃদ্ধিতে

বিশ্বব্যাংক সতর্ক করে বলেছে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বৈশ্বিক বাণিজ্যনীতির অনিশ্চয়তা— বিনিয়োগ, রপ্তানি ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আরও দুর্বল করে দিতে পারে। তবে কিছু বাহ্যিক চাপ কিছুটা প্রশমিত হয়েছে, যেমন ব্যালান্স অব পেমেন্ট ঘাটতি হ্রাস ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল হওয়া যার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিঘ্ন, সংস্কার বাস্তবায়নের দুর্বলতা, অব্যাহত মুদ্রাস্ফীতি, মৌসুমি জ্বালানি ঘাটতি এবং ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা— অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে আরও পিছিয়ে দিতে পারে।”

অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

বিশ্বব্যাংকের চিত্র তুলে ধরেছে দেশের বাস্তবতাই, বলেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান।

সামষ্টিক অর্থনীতির বিদ্যমান বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি এই পূর্বাভাসে উঠে আসলেও– অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগের কারণে অর্থনৈতিক তথ্যউপাত্তের স্বচ্ছতা নিশ্চিত হওয়ার ফলেও এটি সম্ভব হয়েছে বলে স্বীকার করেন তিনি।

মুস্তাফিজুর বলেন, “অর্থনীতি বিগত এক বছরে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে।” তিনি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে বিনিয়োগে স্থবিরতা, প্রবৃদ্ধি হ্রাস ও চাকরি সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে উল্লেখ করেন।

তবে তিনি উচ্চ মুদ্রাস্ফীতিকে সবচেয়ে ক্ষতিকর উপাদান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যা নিম্ন আয়ের ও আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবারগুলোর ক্রয়ক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

দারিদ্র্য হ্রাসে বাংলাদেশের অনেক অগ্রগতির পরেও— আজো অনেক নাগরিক এই দুর্বল সীমায় অবস্থান করছেন। “শুধু দুই দিনের কাজ না পেলে প্রায় ২০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে যেতে পারে,” বলেন তিনি।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, তাই মূল্যস্ফীতির লাগাম টানাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। এর জন্য আর্থিক ও রাজস্ব নীতিকে আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হবে। তিনি সতর্ক করেন, বর্তমান ১০ শতাংশ পলিসি রেট (নীতি সুদহার) কমানোর সুযোগ নেই, যতক্ষণ না মূল্যস্ফীতি কমে।

চাকরি সৃষ্টি ও প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ উৎসাহিত করাও গুরুত্বপূর্ণ, তবে ব্যবসার ব্যয় কমানোও জরুরি। পরিবহন, লজিস্টিকস ও ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়ন জরুরি বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

আগামী মাসেই ঘোষিত হতে যাচ্ছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট। এ প্রেক্ষাপটে তিনি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনার আহ্বান জানান, যাতে লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা নিশ্চিত করা যায় এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়।

২০২৫-২৬ অর্থবছরে কিছুটা আশার আলো?

বর্তমান হতাশাজনক চিত্রের মধ্যেও বিশ্বব্যাংক আশার সম্ভাবনা দেখছে, সংস্থাটির মতে, গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংস্কারের ফলে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪.৯ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। একইসঙ্গে, মূল্যস্ফীতি কমে ৭.৭ শতাংশে নামতে পারে, যা চলতি বছরের ১০ শতাংশের চেয়ে কম।

তবে আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসই সবচেয়ে নৈরাশ্যবাদী। মাত্র একদিন আগেই আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য আগামী অর্থবছরে ৬.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি ৫.২ শতাংশে নেমে আসার প্রক্ষেপণ করেছে। একইভাবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ৫.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ও ৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতির পূর্বাভাস দেয়।

দক্ষিণ এশিয়াতেও ম্লান অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তার ছায়া পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার ওপরও। বিশ্বব্যাংকের আঞ্চলিক প্রতিবেদন বলছে, ২০২৫ সালে দক্ষিণ এশিয়ার প্রবৃদ্ধি ৫.৮ শতাংশে নামবে, যা আগের পূর্বাভাস থেকে ০.৪ শতাংশ পয়েন্ট কম।

তবে ২০২৬ সালে প্রবৃদ্ধি ৬.১ শতাংশেউন্নীত হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।

কাঠামোগত সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজার বলেন, “গত দশকের একাধিক অভিঘাতের ফলে, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর আর্থিক সহনশীলতা কমে গেছে। এখনই সময় বাণিজ্য উন্মুক্ত করা, কৃষিখাত আধুনিকায়ন এবং বেসরকারি খাতকে গতিশীল করার।”

ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

Leave a Reply




Contact Us