ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস মারা গেছেন। ভ্যাটিকান জানিয়েছে, গতকাল স্থানীয় সময় সকাল ৭টা ৩৫ মিনিটে কাসা সান্তা মার্তায় নিজ বাসভবনে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি ছিলেন রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত প্রথম লাতিন আমেরিকান। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিশ্বনেতারা।
নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পাঁচ সপ্তাহ ইতালির রোমে একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পর কিছুটা সুস্থ হয়ে ভ্যাটিকানে ফিরেছিলেন কয়েকদিন আগে। আর্জেন্টিনায় জন্ম নেয়া পোপ ফ্রান্সিস এক যুগের বেশি সময় ধরে সারা বিশ্বের ক্যাথলিকদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। মৃত্যুর আগের দিন অর্থাৎ রোববার হুইলচেয়ারে বসে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার বারান্দা থেকে উচ্ছ্বসিত ভক্তদের উদ্দেশে হাত নেড়ে ইস্টার সানডের শুভ কামনা জানিয়েছিলেন।
পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুতে সাতদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা দিয়েছে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং সাবেক দুই প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও বারাক ওবামা শোক জানিয়েছেন। পোপ ফ্রান্সিসকে স্মরণ করেছেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলনি, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজ, স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজসহ আরো অনেক দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা। ব্রিটেনের রাজা চার্লস ও প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার আলাদাভাবে তাদের শোক জানিয়েছেন।
ফিলিস্তিনের খ্রিস্টানরাও বেদনার্ত হয়েছেন পোপ ফ্রান্সিসের প্রয়াণে। তাদের কথায় এ ভূখণ্ডে শান্তির জন্য যারা কথা বলেছেন সে রকম এক বন্ধুকে হারালেন তারা। বিভিন্ন সময় তিনি ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস পোপ ফ্রান্সিসকে ফিলিস্তিনের মানুষের বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, ‘তিনি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং ভ্যাটিকানে ফিলিস্তিনের পতাকা উত্তোলন অনুমোদন করেন।’
২০১৩ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে পোপ ফ্রান্সিস তার উদারনীতির জন্য এক দশকের বেশি সময় ধরে আলোচিত হয়েছেন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সবসময় কথা বলেছেন তিনি। এ রকমটা কোনো পোপের ক্ষেত্রে আগে দেখা যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে তার উদ্বেগ ও জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বাইরেও তাকে বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল। ধর্মীয় নেতা হলেও তিনি স্বতন্ত্র একটি কণ্ঠ হিসেবে সম্মানিত হয়েছেন। ক্যাথলিক, নন-ক্যাথলিক ও অন্য ধর্মের মানুষের মধ্যে তিনি ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। ধর্মযাজকের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার এবং কানাডার আদিবাসীদের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চেয়ে তিনি প্রশংসিত হয়েছেন।
দায়িত্ব নেয়ার পরই তিনি পোপদের জন্য নির্ধারিত বড় অ্যাপার্টমেন্টে না উঠে ভ্যাটিকানের সাদামাটা সান্তা মার্তা হোস্টেলের একটি ছোট কক্ষে বসবাস করেছেন। নিজের ফোন নিজেই রিসিভ করতেন। সম্ভব হলে গাড়িতে না উঠে হেঁটেই গন্তব্যে যেতেন। সাদাসিধা জীবনযাপন করলেও রীতি ভেঙে অনেক পদক্ষেপ নেয়ায় তাকে রক্ষণশীলদের সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। তার বিরুদ্ধে চার্চের ঐতিহ্য ধ্বংসের অভিযোগ আনা হয়েছে। অনেকের অভিযোগ, পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিলেও যথেষ্ট পরিবর্তন তিনি আনতে পারেননি।
রোমের বিশপ হিসেবে পোপ ফ্রান্সিস বিশ্বব্যাপী ক্যাথলিক চার্চ এবং সার্বভৌম ভ্যাটিকান সিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ভ্যাটিকানের দাপ্তরিক ওয়েবসাইট ‘দি হোলি সি’-এর তথ্যমতে, পোপ ফ্রান্সিসের নাম জর্জ মারিও বারগোগ্লিও। ১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর, আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসে জন্ম তার। বাবা মারিও আর রেগিনা সিভোরি। ইতালীয় অভিবাসী বাবা মারিও ছিলেন রেলওয়ের হিসাবরক্ষক। কেমিস্ট হিসেবে প্রশিক্ষণ নেয়ার পর ধর্মের পথে পা বাড়ান জর্জ মারিও। পরে তিনি দর্শন ও ধর্মতত্ত্বে পড়াশোনা করেন। ১৯৬৯ সাল ধর্মযাজক হন। ১৯৯৮ সালে আর্জেন্টিনায় আর্চবিশপ হন তিনি। বয়স ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে ২০১৩ সালে তৎকালীন পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট পদ ছেড়ে দিলে পোপ নির্বাচিত হন জর্জ মারিও। নতুন নাম হয় ফ্রান্সিস।
২০১৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন তিনি। তাদের জীবনের দুর্দশার জন্য তিনি রোহিঙ্গাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয় পোপ ফ্রান্সিসের আত্মজীবনী ‘হোপ’। পোপ ফ্রান্সিসের শেষকৃত্য শুক্রবার সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, বিশপ ও ধর্মীয় প্রতিনিধিরা এতে যোগ দেবেন। তার ইচ্ছানুযায়ী ব্যাসিলিকা দা সান্তা মারিয়া মাগিওরের পাশে পোপ ফ্রান্সিসকে সমাহিত করা হবে।
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন