চলতি বছরের ২ এপ্রিল নতুন পারস্পরিক শুল্ক নীতির ঘোষণা করেন ট্রাম্প। তার পর থেকেই লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে থাকে ডলারের দাম। নিম্নমুখী হয় বন্ডের বাজার মূল্যও। কিন্তু ‘ইল্ড’ ঊর্ধ্বমুখী থাকায় সমস্যা বেড়েছে। আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, এই অবস্থা চলতে থাকলে বিশ্ব অর্থনীতিতে আসবে সুনামি। তখন সঙ্কটমোচন ‘নিরাপদ আশ্রয়দাতা’র তকমাও হারাতে পারে আমেরিকা। ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের ‘কুপ্রভাব’ বুঝতে হলে, মার্কিন বন্ড এবং ‘ইল্ড’ সম্পর্কে জানা জরুরি। আমেরিকার কোষাগার (পড়ুন ইউএস ট্রেজারি) সাধারণত ১০ বছরের মেয়াদে ট্রেজারি নোট ইস্যু করে থাকে। চলতি কথায় একেই বলা হয় বন্ড। এর মাধ্যমে বাজার থেকে অর্থ ধার করে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। বিনিময়ে সুদ প্রদান করেন তারা। অর্থনীতির পরিভাষায় ওই সুদকে বলা হয় ‘ইল্ড’।
বর্তমানে ৮০ হাজার কোটি ডলারের মার্কিন বন্ড রয়েছে চিনের হাতে। এ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য কিছু দেশও আমেরিকার বন্ডের অধিকারী। ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতির ফলে সংশ্লিষ্ট বন্ডগুলি বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা তুলে নিতে চাইছেন তারা। কিন্তু আমেরিকার উপর আস্থা চিড় খাওয়ায় ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে বন্ডের দাম। আর এইখানেই তৈরি হয়েছে সমস্যা। বন্ডের দরের পতনের জেরে দিন দিন চড়ছে ‘ইল্ড’ বা সুদের হার। মার্কিন কোষাগারের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছরের ২ এপ্রিলের আগে পর্যন্ত বন্ডের ‘ইল্ড’ ছিল চার শতাংশ। কিন্তু, ট্রাম্প নতুন শুল্ক নীতি ঘোষণার পর মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সেটি ৪.৫ শতাংশে পৌঁছে যায়। অর্থাৎ ‘ইল্ড’ বৃদ্ধি পেয়েছে ০.৫ শতাংশ।
একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি বোঝা যেতে পারে। ধরা যাক, ১০০ ডলার মূল্যের একটি ট্রেজারি নোট বা বন্ড বাজারে নিয়ে এল যুক্তরাষ্ট্রের কোষাগার। ওই বন্ড কিনলে বছরে ১০ ডলার করে সুদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন তারা। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে বার্ষিক ১০ শতাংশ হারে সুদ পাবেন গ্রাহক। বিক্রির সময়ে দাম হ্রাস পাওয়ায় জটিল হয়েছে এই অঙ্ক। আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, ট্রাম্পের শুল্ক নীতির ফলে ওই বন্ডই এখন ৯০ ডলারে গ্রাহককে বিক্রি করতে হচ্ছে। কিন্তু, এ ক্ষেত্রেও বছরে ১০ ডলার করে সুদ দেবে যুক্তরাষ্ট্রের কোষাগার। কারণ, সুদের হার বা ‘ইল্ড’ বৃদ্ধি পেয়ে পৌঁছে গিয়েছে ১১.১ শতাংশে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ২০০১ থেকে শুরু করে গত ২৫ বছরে কখনই এক সপ্তাহে বৃদ্ধি পায়নি মার্কিন বন্ডের ‘ইল্ড’-র অঙ্ক।
আমেরিকার বন্ডের শুল্ক হ্রাস এবং ‘ইল্ড’র ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা নিয়ে ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির বিভাগীয় প্রধান আনাস্তাসিয়া ফেডিক। তাঁর কথায়, ‘‘বিনিয়োগকারীদের চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন ট্রাম্প। ফলে আমাদের বন্ডের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে গোটা দুনিয়া। এতে আর্থিক পরিস্থিতি মারাত্মক ভাবে দুর্বল হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।’ বন্ডের মূল্য হ্রাস এবং ‘ইল্ড’ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় আমেরিকার উপর বৃদ্ধি পাচ্ছে ঋণের বোঝা। ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণের পরিমাণ ৩৬.২২ লক্ষ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি ২০০৮ সালের মত আর্থিক সঙ্কট আসতে পারে বলে সতর্ক করেন আর্থিক বিশ্লেষকের দল। এতে চাপে পড়ে চিন বাদে বাকি দেশগুলির ক্ষেত্রে ৯০ দিনের জন্য নতুন শুল্ক নীতি স্থগিত রেখেছেন ট্রাম্প।
অন্য দিকে বন্ডের পাশাপাশি বিশ্ব বাজারে শুরু হয়েছে ডলারের অবমূল্যায়ণ। ব্রিটিশ পাউন্ড থেকে শুরু করে ইউরো কিংবা সুইটজ়ারল্যান্ড ও জাপানের মুদ্রার ক্রমাগত দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বিশ্বের একাধিক দেশ বিদেশি মুদ্রা ভান্ডারে কমাচ্ছে ডলারের পরিমাণ। বদলে স্বর্ণ ভান্ডার বৃদ্ধির দিকে নজর দিয়েছেন তারা। সেই তালিকায় রয়েছে ভারতও। দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে সোনার দাম। ডলার ইনডেক্স অনুযায়ী, গত তিন মাসে দাম মারাত্মক হারে কমেছে আমেরিকান মুদ্রার মূল্য। একটা সময়ে এটি ১১০-এ উঠেছিল। বর্তমানে সেখান থেকে নেমে ৯৯.৭৮ চলে এসেছে ডলার মূল্য। যা আগামী দিনে আরও হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এত দিন পর্যন্ত বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম সুদে বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে বাজার থেকে টাকা তুলতে পারছিল আমেরিকা। পাশাপাশি, ডলারকে একটি শক্তিশালী বিদেশি মুদ্রা হিসাবে গণ্য করা হত। দু’টি ক্ষেত্রেই ধাক্কা লাগায় বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ‘ফেডারেল রিজার্ভ’। সম্প্রতি এ ব্যাপারে একটি বিবৃতি দেয় আমেরিকার ‘ফেডারেল রিজার্ভ’। সেখানে বলা হয়, ‘‘বাণিজ্য নীতি যে ভাবে ওঠা-নামা করছে তাতে বিনিয়োগকারীরা স্তম্ভিত। তাঁরা যে অন্য দিকে মুখ ফেরাবেন, তা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু সবচেয়ে বেশি সমস্যার মুখে পড়ছি আমরা। একটি শক্তিশালী নীতি তৈরি করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে।’’
ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতোই সুদের হার নির্ধারণ করার ক্ষমতা রয়েছে মার্কিন ফেড রিজ়ার্ভের। ট্রাম্পের নীতি ফলে উভয় সঙ্কটে পড়েছে এই সংস্থা। বিশ্লেষকদের বলেছেন এই পরিস্থিতিতে সুদের হার হ্রাস করলে আমজনতার হাতে বাড়বে টাকার পরিমাণ। কিন্তু, সে ক্ষেত্রে আকাশছোঁয়া হতে পারে মূল্যবৃদ্ধির সূচক। আবার উল্টো পথে হেঁটে ফেডারেল রিজ়ার্ভ সুদের হার বৃদ্ধি করলে ঘোর সঙ্কটে পড়তে পারে আমেরিকার অর্থনীতি। তাতে আরও কমবে রাজস্ব আয়। বাণিজ্য ঘাটতি প্রবল ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশ্লেষকেরা।
যুক্তরাষ্ট্রের কোষাগারের প্রাক্তন সচিব জ্যানেট লুইস ইয়েলেন বলেছেন, ‘‘পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে, তাতে আমেরিকার বাজার এখন জটিল এবং বিপদ সঙ্কুল। এখানকার লগ্নিকারীরা অন্যত্র বিনিয়োগের রাস্তা খুঁজছেন। এটা আমেরিকার জন্য সবচেয়ে বড় আর্থিক বিপদ। কারণ, একের পর এক বিনিয়োগকারী অন্যত্র চলে গেলে শেয়ার বাজারে নামবে ধস। তাতে আরও বৃদ্ধি পাবে লোকসানের অঙ্ক।’’ মার্কিন ডলার এবং বন্ডের মূল্য হ্রাসের প্রভাব পড়ছে ভারতের বাজারেও। ভাল রকমের রক্তক্ষরণ প্রত্যক্ষ করেছে এদেশের দু’টি স্টক এক্সচেঞ্জ। ট্রাম্প ঘনিষ্ঠদের একাংশ মনে করেন ডলারের বদলে আমেরিকার অর্থনীতিকে ক্রিপ্টো মুদ্রায় বদলে ফেলার পরিকল্পনা রয়েছে ট্রাম্পের। তবে এর ভান্ডার তৈরি করা মোটেই সহজ নয়, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন