কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ অর্থবছরে মোট রেমিট্যান্স ৩৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে, যা আগের বছরের ৩০ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় অনেক বেশি।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া তথ্য অনুসারে, প্রবাসী আয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় গত মার্চ মাসে দেশটির চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে। বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) এই তথ্য প্রকাশ করা হয়।
মার্চে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত অর্থের পরিমান ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, যা এই ধরনের পরিসংখ্যান সংরক্ষণের পর থেকে সর্বোচ্চ। টপলাইন সিকিউরিটিজের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এর আগে মাসিক সর্বোচ্চ উদ্বৃত্ত হয়েছিল ২০১২ সালের আগস্টে—৯৮১ মিলিয়ন ডলার।
গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছরের মার্চে উদ্বৃত্তের পরিমাণ বেড়েছে ২২৯ শতাংশ। তবে ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান ৯৭ মিলিয়ন ডলারের ঘাটতিতে ছিল। ২০২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে পাকিস্তান মোট ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত দেখেছে, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। দেশের পরিশোধযোগ্য অর্থের ভারসাম্য রক্ষায় রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মার্চে রেমিট্যান্স প্রবাহ এসে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারে, যা পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। পাশাপাশি, বিদেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধিও রেমিট্যান্স বাড়াতে সহায়ক হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ অর্থবছরে মোট রেমিট্যান্স ৩৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে, যা আগের বছরের ৩০ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় অনেক বেশি।
ইসমাইল ইকবাল সিকিউরিটিজের রিসার্চ প্রধান সাদ হানিফ বলেন, ‘মার্চের উদ্বৃত্ত আশাব্যঞ্জক। তবে ঈদের পর রেমিট্যান্স প্রবাহ স্বাভাবিক হয়ে এলে এবং অর্থনীতি ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার করা হলে আমদানি চাহিদা বাড়বে—ফলে এই ধারা ধরে রাখা কঠিন হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আইএমএফ-সমর্থিত সংস্কার, বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহে উন্নতি এবং তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল রুপি চলতি হিসাবকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক হবে বলেই আশা করা হচ্ছে। তবে বিশ্ববাজারে তেলের দামে হঠাৎ বৃদ্ধি কিংবা নীতিগত বিচ্যুতি এই ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’
তবে মার্চে রেকর্ড উদ্বৃত্তের পরও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে কোনো ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়নি। কারণ একই সময় ব্যাংকিং খাত ও ঋণের কারণে তৈরি হওয়া ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের বড় ঘাটতি দেখা দেয় বলে জানান হানিফ।
প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ মার্চ ২০২৫-এ ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্তে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
এদিকে, পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে পড়া বিদ্যুৎ খাতকে চাঙা করতে ১ দশমিক ২৭৫ ট্রিলিয়ন রুপি (৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার) মূল্যের একটি পুনঃঋণ সহায়তা চুক্তিতে সই করেছে। ঘূর্ণায়মান ঋণের চাপ কমানো এবং সম্ভাব্য জ্বালানি সংকট এড়াতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র।
তারা জানায়, এইচবিএল ব্যাংকের করাচি শাখায় সরকার এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলির মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং আগামী মাস থেকেই অর্থ ছাড় শুরু হতে পারে।
তবে ‘দ্য নিউজ’ এই বিষয়ে এইচবিএলের মিডিয়া কনসালট্যান্টের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি চুক্তির সত্যতা নিশ্চিত করলেও বিস্তারিত জানাতে অস্বীকৃতি জানান।
চুক্তির আওতায় ব্যাংকগুলো পাকিস্তান হোল্ডিং কোম্পানি লিমিটেডের (পিএইচসিএল) মাধ্যমে পূর্বে ইস্যুকৃত টার্ম ফাইন্যান্স সার্টিফিকেটের (টিএফসি) বিপরীতে ৬৫৮ বিলিয়ন রুপি পুনঃঋণ দেবে এবং সরকার পরিচালিত সেন্ট্রাল পাওয়ার পারচেসিং এজেন্সিকে (সিপিপিএ) ৬১৭ বিলিয়ন রুপির নতুন ঋণ প্রদান করবে। এই সিপিপিএ বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনে।
এই অর্থ ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন রুপির ঘূর্ণায়মান ঋণের একটি অংশ পরিশোধে ব্যবহৃত হবে, যা বিদ্যুৎ খাতে তারল্য সংকট তৈরি করেছে এবং সরকারের আর্থিক ব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে।
চুক্তি অনুযায়ী, ঋণের সুদের হার ধরা হয়েছে ১০ দশমিক ৫ থেকে ১১ শতাংশ, যা করাচি ইন্টারব্যাংক অফার রেট-এর সঙ্গে ৯০ বেসিস পয়েন্ট যোগ করে নির্ধারিত হয়েছে এবং তা ছয় বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।
এই উদ্যোগে অংশ নিয়েছে ১৮টি ব্যাংক। ২০২৪ সালের আর্থিক বিবরণের ভিত্তিতে এই ব্যাংকগুলো অর্থায়ন করবে। সবচেয়ে বেশি ঋণ দেবে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, এরপর রয়েছে হাবিব ব্যাংক, ইউনাইটেড ব্যাংক, এমসিবি এবং অন্যান্য ব্যাংক। বিদ্যুৎ খাতের আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এটি পাকিস্তানের ব্যাংক খাতের অন্যতম বৃহৎ সমন্বিত উদ্যোগ।
অন্যদিকে, ২০২৫ সালের মার্চে পাকিস্তানের টেক্সটাইল রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বার্ষিক ভিত্তিতে ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ বেড়ে রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলারে।
ফেব্রুয়ারিতে স্থবিরতা থাকলেও মার্চে খাতটি আবার দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। তবে ফেব্রুয়ারির তুলনায় এই বৃদ্ধি ছিল মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ—ফেব্রুয়ারিতে রপ্তানি ছিল ১ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার—যা টানা কয়েক মাসের উচ্চ প্রবৃদ্ধির পর মন্দার ইঙ্গিত দিতে পারে।
ফেব্রুয়ারিতে রপ্তানিতে মাত্র ০ দশমিক ৪৪ শতাংশ বৃদ্ধি দেখা গিয়েছিল, যা আগস্ট ২০২৪ থেকে জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত সময়ের শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির ধারার বিপরীত অবস্থান তুলে ধরে।
আমদানির ক্ষেত্রে, মার্চে পেট্রোলিয়াম গ্রুপের আমদানি বার্ষিক ভিত্তিতে ১৮ শতাংশ কমে ১ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। অপরিশোধিত তেল আমদানি ৩২ শতাংশ কমে ৪৩১ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলারে নেমেছে, এলএনজি আমদানি ২২ দশমিক ৯ শতাংশ কমে ২২৬ মিলিয়ন ডলার এবং এলপিজি আমদানি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ কমে ৭৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। কেবল পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম পণ্যের আমদানিতে সামান্য ০ দশমিক ৬৪ শতাংশ বৃদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়েছে ৫০০ মিলিয়ন ডলারে।
যন্ত্রপাতি আমদানি ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেড়ে ৮২২ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। মোবাইল ফোন আমদানি মার্চে ১৪ দশমিক ২ শতাংশ কমে ১৩১ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
পরিবহন খাতে আমদানি মার্চে ৬৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১৪ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলারে। এর মধ্যে মোটরগাড়ির সম্পূর্ণ প্রস্তুত ইউনিট আমদানি ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে ২৪ মিলিয়ন ডলার হয়েছে, আর সম্পূর্ণ ও আধা-সংযোজিত গাড়ি ও ভারী যানবাহনের আমদানি ৯০ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে ১৫২ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। মোটরসাইকেল আমদানি ৬৪ শতাংশ বেড়ে ৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে, বৃহস্পতিবার পাকিস্তান প্রাইভেটাইজেশন কমিশন রাষ্ট্রীয় উড়োজাহাজ সংস্থা পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স করপোরেশন লিমিটেডের নিয়ন্ত্রণমূলক শেয়ার বিক্রির জন্য সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের প্রাক-যোগ্যতা নির্ধারণে নীতিমালা অনুমোদন করেছে। আগামী সপ্তাহে এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট (ইওআই) আহ্বান করা হবে, যেখানে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা ৫১ থেকে ১০০ শতাংশ শেয়ার কেনার সুযোগ পাবেন।
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রথমত, যোগ্যতা নির্ধারণের মানদণ্ড আরও নির্দিষ্ট করা হয়েছে যাতে শুধুমাত্র সক্ষম কোম্পানিগুলোকেই বিবেচনায় নেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত, অতিরিক্ত প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে—যেমন নতুন উড়োজাহাজ আমদানিতে জিএসটি ছাড় এবং বিমানের ব্যালান্স শিট থেকে ঋণ বাদ দিয়ে ‘নেট-জিরো’ হিসেবে শেয়ার উপস্থাপন।’
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন