চাকরি ছাড়তে শুরু করেছেন জাপানিরা; কারণ কী? – The Finance BD
 ঢাকা     মঙ্গলবার, ০৮ Jul ২০২৫, ০৪:১৪ অপরাহ্ন

চাকরি ছাড়তে শুরু করেছেন জাপানিরা; কারণ কী?

  • ০৭/০৪/২০২৫

একসময় জাপানে চাকরি ছেড়ে নতুন চাকরি নেওয়া রীতিমতো নিষিদ্ধ কাজ হিসেবে দেখা হতো। কেউ চাকরি ছাড়তে চাইলে ‘বিশ্বাসঘাতক’ গালি পর্যন্ত শুনতে হতো। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি বদলে গেছে। কারণ কী?
কাওয়াতা ইয়াসুতোশি কখনোই প্রথাগত জাপানি কর্পোরেট জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি। হেভি-মেটাল ব্যান্ডের প্রাক্তন গিটারিস্ট ইয়াসুতোশির কাছে বড় ইলেকট্রনিক্স কোম্পানিতে চাকরি করা দুঃসহ মনে হতো। বিশেষ করে সেখানকার কঠোর সিনিয়র-জুনিয়র নিয়মকানুনকে কঠিন লাগত বেশি। এ সংস্কৃতিতে জুনিয়র কর্মীদের কাজ শুধু উর্ধ্বতনদের নির্দেশ মানা। কাজের ধরনেও ছিল প্রচুর অপচয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত ডেস্কে বসে, নয়তো রাতে সহকর্মীদের সঙ্গে বাধ্যতামূলক পান-ভোজনে। চাকরি ছেড়ে অন্যত্র যাওয়া আরও জটিল। এক দশক আগে কাওয়াতা যখন একটি আন্তর্জাতিক আইটি কোম্পানিতে যোগ দয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, তার সিনিয়ররা কড়া কড়া কথা শোনালেন—এমনকি তাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলতেও ছাড়লেন না। এখন বয়স যখন প্রায় পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই, ফের নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছেন কাওয়াতা। ‘আমি চ্যালেঞ্জের জন্য ক্ষুধার্ত হয়ে ছিলাম,’ বলেন তিনি। বর্তমান সময়ে কাওয়াতা আর ব্যতিক্রম নন। একসময় জাপানে আদর্শ কর্মী বলতে বোঝাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করে আসা এক তরুণ, যে আজীবন একটিই কোম্পানিতেই কাজ করবে—বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জুটবে পদোন্নতি ও নানা সুবিধা। কিন্তু সেই কঠোর ‘স্যালারিম্যান’ সংস্কৃতি এখন ভাঙতে শুরু করেছে। পশ্চিমা দেশের তুলনায় জাপানে চাকরি বদলানোর হার এখনও কম, তবু দেশটিতে এই প্রবণতা বাড়ছে। ২০২৪ সালে প্রায় ৯ লাখ ৯০ হাজার স্থায়ী কর্মী পূর্ণকালীন চাকরি ছেড়ে অন্য চাকরিতে যোগ দিয়েছেন—যা এক দশকের আগের তুলনায় ৬০ শতাংশ বেশি। টোকিও চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির এক জরিপে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে মাত্র ২১ শতাংশ তরুণ কর্মী বলেছেন, তারা অবসর পর্যন্ত বর্তমান কর্মস্থলেই থাকতে চান—যেখানে ২০১৪ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ৩৫ শতাংশ।
এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে জাপানের জনমিতিক বাস্তবতা। কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমে আসায় চাকরি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কর্মীদের দরকষাকষির ক্ষমতা বেড়েছে। এক জরিপ অনুসারে, অর্ধেকেরও বেশি জাপানি কোম্পানি স্থায়ী কর্মীর সংকটে ভুগছে। এমনকি জাপানের একসময়কার শক্তিশালী সিভিল সার্ভিসের চাকরিও ছেড়ে দিচ্ছেন মেধাবী তরুণরা। জাপানের আদর্শ স্যালারিম্যান কর্মীদের উত্থান ঘটেছিল যুদ্ধ-পরবর্তী বিকাশের সময় (সম্রাট হিরোহিতোর শোয়া আমলে)। তাদের আনুগত্যের প্রমাণ ছিল অফিসে দীর্ঘ সময় দেওয়া, আর পরে সহকর্মীদের সঙ্গে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা। ১৯৮০-র দশকের একটি বিখ্যাত এনার্জি ড্রিংকের বিজ্ঞাপনে কর্পোরেট যোদ্ধাদের নিবেদনের উযাপনে প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হয়েছিল: ‘আপনি কি ২৪ ঘণ্টা লড়তে পারবেন?’
কিন্তু তরুণ প্রজন্ম এখন এই ধাঁচের কর্মজীবন নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। পিতৃত্বকালীন ছুটি নেওয়া কর্মীর সংখ্যা ১০ বছর আগে যেখানে ছিল ২ শতাংশ, ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ শতাংশে। হিতোৎসুবাশি ইউনিভার্সিটির বিজনেস স্কুলের ওনো হিরোশি বলেন, ‘শোয়া যুগের (১৯২৬–১৯৮৯) কাজের ধরন ভেঙে পড়ছে। বহু জাপানি মানুষ তাদের কাজে কোনো আনন্দ খুঁজে পান না।’ ছোটবেলায় ট্রেনে তিনি যেসব স্যালারিম্যানদের দেখতেন, তাদের দেখে মনে হতো জিন্দালাশ। সেই করুণ পরিণতির অংশ হতে চাননি ওনো। তাই নিজেই একটি রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি গড়ে তুলেছেন, যেখানে চাকরিজীবীদের সঙ্গে সামাজিক সমস্যার সমাধান করতে চাওয়া স্টার্টআপের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন তিনি।
অফিসে ভিন্ন প্রজন্মের কর্মীদের ভেতর দানা বাঁধছে উত্তেজনা। তরুণ কর্মীদের অভিযোগ—অফিসে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছেন ‘হাতারাকানাই ওজিসান’, অর্থাৎ ‘যারা কাজ করেন না, এমন বৃদ্ধরা’। তরুণদের ভাষ্যমতে, এই অভিজ্ঞ কর্মীদের অবদান সামান্য, কিন্তু কঠোর শ্রম আইন তাদের অটল সুরক্ষা দিয়ে রেখেছে। ২০২২ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, যেসব কর্মীর বয়স ২০ ও ৩০-এর কোঠায়, তাদের প্রায় অর্ধেকই বলেছেন, এই প্রবীণ সহকর্মীদের কারণে কর্মস্থলের মনোবল নষ্ট হচ্ছে। এই প্রবীণ কর্মীরাই ম্যানেজমেন্টের উচ্চ পদ আঁকড়ে থাকেন; ফলে তরুণ কর্মীদের ওপরের ওঠার সুযোগ প্রায় নেই। প্রবীণ অলস কর্মীদের ব্যঙ্গ করে ‘উইন্ডোজ ২০০০’—অর্থাৎ মান্ধাতার আমলের প্রযুক্তি—বলে ডাকেন তরুণরা। প্রবীণ কর্মীদের বার্ষিক মোটা বেতন দেওয়া হয় (২০ মিলিয়ন ইয়েন বা ১ লাখ ৩২ হাজার ডলার)। মহামারিকালে জাপানের বেকারত্বের হার ছিল প্রায় ৩ শতাংশ—যেখানে আমেরিকায় তা ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ১৫ শতাংশে পৌঁছেছিল। ওনো হিরোশি জাপানের এই কঠোর শ্রম বাজারকে তুলনা করেন ‘একটি স্থবির বাথটাবের’ সঙ্গে—যার পানি না ফেলে দেওয়া যায়, না বদলানো যায়।
এই পরিস্থিতিতে শ্রমনীতি সংস্কারের দাবি জোরালো হচ্ছে। ২০১৯ সালে জাপানের বৃহত্তম ব্যবসায়ী সংগঠন কেইদানরেন-এর তৎকালীন প্রধান ঘোষণা দেন, আজীবন চাকরির ব্যবস্থাটি ‘আর টেকসই নয়’। অতি সম্প্রতি গত বছর লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতৃত্ব বাছাইয়ের সময় অন্যতম প্রার্থী কোইজুমি শিনজিরো চাকরি থেকে ছাঁটাই সহজ করার পক্ষে কথা বলেন। তবে এই প্রস্তাব নিয়ে প্রবল বিতর্ক শুরু হয়। রক্ষণশীল প্রার্থীরা সাবধান করেন, তাড়াহুড়ো করে এ ধরনের পরিবর্তন আনা বিপজ্জনক হতে পারে। তবু, নীতিনির্ধারণে গতি না থাকলেও, প্রবীণ কর্মীদের মানসিকতায় বদল আসছে। জাপানে একসময় বিখ্যাত একটি ধারণা ছিল ‘৩৫ বছরের সীমা’—যার অর্থ, এই বয়সের পরে ক্যারিয়ার বদল প্রায় অসম্ভব। কিন্তু সেই তত্ত্ব এখন ধসে পড়ছে। রিক্রুট নামক একটি কর্মসংস্থান এজেন্সির তথ্যানুযায়ী, গত এক দশকে ৪০ ও ৫০-এর কোঠায় থাকা জাপানিদের মধ্যে চাকরি বদলানোর হার ছয়গুণ বেড়েছে।
৪৪ বছর বয়সি ওয়াকাতসুকি মিতসুরু সম্প্রতি দুই দশকের বেশি সময় কাজ করা একটি বড় জাপানি কোম্পানি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘চাইলেই আমি হয়তো আরও ২০ বছর ওই চাকরিতে কাটিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু নিজের ভেতর থেকেই প্রশ্ন উথছিল—আমি কি সত্যিই এটা চাই?’ কর্মী সংকটের কারণে যেসব কোম্পানি একসময় শুধুই সদ্য স্নাতক করা তরুণদের নিয়োগে আগ্রহী ছিল, তারাও এখন মাঝারি পর্যায়ের দক্ষ কর্মীদের দিকে ঝুঁকছে। অর্থনীতিতে এই পরিবর্তন বিশাল প্রভাব ফেলছে। জাপানে শ্রমিকদের চাকরি বদলানোর সুযোগ থাকায় বেতন বৃদ্ধি নির্ভর করে ‘শান্তো’ম অর্থাৎ বার্ষিক বসন্তকালীন বেতন আলোচনার ওপর। রিক্রুটের আরেকটি সমীক্ষা বলছে, এখন প্রায় ৪০ শতাংশ চাকরি বদলানো কর্মীর বেতন ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে—যেখানে ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল এক-তৃতীয়াংশেরও কম। ধনী দেশগুলোর তুলনায় জাপানে এখনও বেতন কম হলেও চাকরি বদলানোর হার বাড়তে থাকায় ‘পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে’ বলে উল্লেখ করেন টোকিওর থিংকট্যাঙ্ক সোমপো ইনস্টিটিউট প্লাস-এর অর্থনীতিবিদ কোইকে মাসাতো। এমন পরিবর্তন জাপানের পুরনো প্রতিষ্ঠানে নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে পারে। চাকরি বদলানো ওয়াকাতসুকি তার আগের কর্মস্থলের কথা ভেবে বলেন, ‘একই মানুষ যদি একই প্রতিষ্ঠানে বছরের পর বছর ধরে পড়ে থাকে, তাদের চিন্তাভাবনাও অন্তর্মুখী হয়ে যায়। ‘
তার এই ভাবনার সাথে একমত কাওয়াতাও, যদিনি এখন আইটি কর্মী। ‘জাপানি কোম্পানিগুলোর বাইরে থেকে একঝাঁক নতুন হাওয়া দরকার,’ বলেন তিনি।

ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

Leave a Reply




Contact Us