২০২২ সালে বিশ্বের ধনীরা সব মিলিয়ে ১৯ হাজার কোটি ডলার দান করছেন, যা ২০১৮ সালের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি। ২০১৮ সালে ধনীরা দান করেছিলেন ১৫ হাজার ২০০ কোটি ডলার।
বিশ্বের ধনী মানুষের মধ্যে দান করার প্রবণতা বাড়ছে। একসময় সামাজিক নানা খাতে অর্থ দানের জন্য আলোচনায় ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন শীর্ষ ধনী। এখন সেই ধারা বদলাতে শুরু করেছে। অনেক ধনী এগিয়ে এসেছেন দানে। ফলে দানের পরিমাণও বাড়ছে।
বৈশ্বিক সংস্থা ওয়েলথ এক্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে বিশ্বের ধনীরা ১৯০ বিলিয়ন বা ১৯ হাজার কোটি মার্কিন ডলার দান করেছেন। ২০১৮ সালের তুলনায় এই পরিমাণ অনেকটাই বেশি। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২২ সালে বিশ্বের অতিধনীরা ২৫ শতাংশ বেশি দান করেছেন। ২০১৮ সালে ধনীরা দান করেছিলেন ১৫ হাজার ২০০ কোটি ডলার।
ওয়েলথ এক্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যাঁদের সম্পদমূল্য ৩ কোটি ডলার বা তার চেয়ে বেশি, সেই শ্রেণির মানুষেরা দানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। ২০২২ সালে ধনীরা যত দান করেছেন, তার মধ্যে ৩৮ শতাংশই ছিল এ শ্রেণির ধনীদের দান। সেই তুলনায় বরং বিলিয়নিয়ার বা শতকোটিপতিদের দানের প্রবণতা কম। ২০২২ সালে ধনীরা যত দান করেছেন, তার মধ্যে মাত্র ৮ শতাংশ করেছেন বিশ্বের ৩ হাজার ২০০ জন শতকোটিপতি। ফলে দাতব্য সংস্থাগুলোর এই শ্রেণির ধনীদের কাছ থেকে আরও বেশি দানের অর্থ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে দানের ক্ষেত্রে আবার এগিয়ে রয়েছেন উত্তর আমেরিকার ধনীরা। ২০২২ সালের ১৯ হাজার কোটি ডলারের প্রায় অর্ধেক বা ৯ হাজার ১০০ কোটি ডলার দান করেছেন উত্তর আমেরিকার ধনীরা। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ অঞ্চলের ধনীদের সম্পদ অন্যান্য অঞ্চলের ধনীদের তুলনায় বেশি; সেই সঙ্গে তাঁদের দান করার প্রবণতাও বেশি। ইউরোপের ধনীরা করেছেন মোট দানের এক-তৃতীয়াংশ। তবে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ইউরোপের ধনীদের দানের পরিমাণ ২৯ শতাংশ বেড়েছে।
ওয়েলথ এক্সের আলট্রা হাইনেট ওর্থ ফিলানথ্রফি ২০২৪-শীর্ষক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের তুলনায় এশিয়ার অতিধনীদের দানের প্রবণতা কম। ২০২২ সালে এশিয়ার অতিধনীদের দানের অংশ ছিল মোট দানের মাত্র ১৩ শতাংশ। যদিও বিশ্বের অতিধনীদের বসবাসের দিক থেকে ইউরোপ এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম অঞ্চল।
ওয়ারেন বাফেট ও ধনীদের দান
বিশ্বের অতিধনীদের দানের প্রসঙ্গ এলেই সবার আগে আসে ওয়ারেন বাফেটের নাম। নিজের সম্পদের বড় অংশ ইতিমধ্যে তিনি দান করে দিয়েছেন। শুধু নিজে দান করেই ক্ষান্ত দিচ্ছেন না তিনি; অন্য ধনীদেরও দান করতে উৎসাহিত করছেন। ২০০৯ সালের মার্চের শুরুতে বিল গেটস বাফেটের শহর ওমাহায় এসেছিলেন। বিমানবন্দরের কাছাকাছি একটি রেস্তোরাঁয় ওয়ারেন বাফেট আর বিল গেটস একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেন। সেটা ছিল নতুন এক আলোচনার সূত্রপাত। এরপর বিল গেটস আর ওয়ারেন বাফেট ২০০৯ সালের ৪ মার্চ যৌথভাবে একটি চিঠি লেখেন আরেক শীর্ষ ধনী ডেভিড রকফেলারকে। চিঠিতে তাঁকে একটি নৈশভোজে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
চিঠি পেয়েই তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন ডেভিড রকফেলার। এরপর ২৪ মার্চ এই তিনজনের স্বাক্ষরে আরেকটি চিঠি পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের আরও কয়েকজনের কাছে। এরপর বহুল আকাঙ্ক্ষিত নৈশভোজটি অনুষ্ঠিত হয় সে বছরের ৫ মে, রকফেলার ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট হাউসে। এই উদ্যোগে শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন বিল গেটসের তৎকালীন স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের ওই সব সেরা ধনী, যাঁরা সম্পদের বড় অংশ ভালো কাজে দান করতে আগ্রহী, তাঁদের নিয়ে যৌথ সিদ্ধান্ত নেওয়া।
ওই নৈশভোজের পরই জনসেবা বা জনহিতকর কাজে দানের বিষয়টি নতুন এক ইতিহাস তৈরি করে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় তহবিল সংগ্রহের কাজটি শুরু হয় এর পর থেকেই। তাঁদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ফোর্বস-এর তালিকায় থাকা ৪০০ মার্কিন ধনীকে উদ্বুদ্ধ করা, যাতে তাঁরা অন্তত অর্জিত সম্পদের অর্ধেক দান করেন। এরপরই ২০১০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয় একটি নতুন উদ্যোগের, নতুন কর্মসূচির। তার আনুষ্ঠানিক নাম ‘দ্য গিভিং প্লেজ’ বা ‘দানের অঙ্গীকার’।
তবে এমন নয় যে, ওই উদ্যোগের আগে কোটিপতিরা দান করতেন না। ২০০৬ সাল থেকেই ওয়ারেন বাফেট নানা ধরনের জনহিতকর কাজে সম্পদ বিলিয়ে দিতে শুরু করেন। বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনে বাফেট সহায়তা দিচ্ছেন আগে থেকেই। কিন্তু তাঁদের সম্মিলিত উদ্যোগের ভাবনা থেকে সৃষ্টি হয় দ্য গিভিং প্লেজের। শর্ত এখানে দুটি। সম্পদের পরিমাণ হতে হবে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি আর দান করতে হবে সম্পদের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ। অবশ্য বিল গেটস তাঁর সম্পদের ৯৫ শতাংশ আর ওয়ারেন বাফেট ৯৯ শতাংশ দান করার ঘোষণা দিয়েছেন তারও আগে।
সর্বশেষ ওয়েলথ এক্সের প্রতিবেদন থেকে ধনীদের দান করার প্রবণতা বৃদ্ধির যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, ধারণা করা যায়, বাফেট ও বিল গেটসের উদ্যোগ তাতে ভালো সাড়া ফেলেছে।
এখনকার ধনীদের প্রবণতা
বাফেট ও গেটসের মতো ধনীদের অনুসরণে এখনকার প্রজন্ম অর্থাৎ মিলেনিয়াল (জন্ম ১৯৮১-১৯৯৬) ও জেন–জি (জন্ম ১৯৯৭-২০২১) প্রজন্মের মানুষেরা দান করেই ক্ষান্ত দেন না, বরং সেই অর্থ কোন খাতে ও কীভাবে ব্যয় করা হবে, সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গেও যুক্ত থাকেন তাঁরা। মিলেনিয়াল ও জেন–জি প্রজন্মের মানুষেরা দানের প্রভাব, স্বচ্ছতা ও উদ্ভাবনী বিষয়ে বেশ মনোযোগী।
বিষয়টি এমন, তরুণ বয়সী ধনীদের বিশ্বাসের সঙ্গে মেলে, এমন খাতে তাঁরা দান করতে আগ্রহী। সেই সঙ্গে লক্ষ্য অর্জনে নিজেরাই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একজোট হয়ে কাজ করতে চায়। অর্থাৎ তরুণ প্রজন্ম একধরনের রূপান্তর ঘটাতে চায়; এখানেই আগের প্রজন্মের সঙ্গে তাদের পার্থক্য।
দাতারা এখন দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরও গভীর ও অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে চায়। এখন আর তারা দান করেই কাজ শেষ করতে চায় না। এই বাস্তবতায় জনকল্যাণমূলক সংগঠনগুলোর কার্যক্রমেও পরিবর্তন এসেছে। এখন দাতাদের বোঝাতে তারা বিভিন্ন উদ্যোগের গল্প তৈরি করছে; দাতাদের সঙ্গে আগের চেয়ে বেশি যোগাযোগ রাখছে। দীর্ঘ মেয়াদে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে এর বিকল্প নেই বলেই তারা মনে করছে।
ফাউন্ডেশন বেড়েছে
ওয়েলথ এক্সের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বের অতিধনীদের অর্থাৎ যাঁদের সম্পদমূল্য ৩ কোটি ডলার বা তার বেশি, তাদের প্রতি পাঁচজনে একজনের ফাউন্ডেশন আছে। ১০ কোটি ডলারের মালিক, এমন ধনীদের ক্ষেত্রে ফাউন্ডেশন আছে প্রায় প্রতি তিনজনে একজনের। এরা অবশ্য মূলত বয়স্ক মানুষ। এদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা কিছুটা বেশি। এই ধনীরা মূলত উত্তরাধিকারসূত্রে পারিবারিক সম্পদ পেয়েছেন।
সূত্র : ওয়েলথ এক্স
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন