সম্পদ বণ্টনে বৈষম্য দূরীকরণ, উন্নয়ন তহবিল জোগান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা, কর ফাঁকি দূর ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ অন্যান্য কারণে শীর্ষ ধনী ব্যক্তিদের ওপর বাড়তি কর আরোপে পরিকল্পনা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ আলোচনায় রয়েছে। একাধিক ফোরামে বিষয়টি উঠে এসেছে। সে আলোচনায় নতুন রসদ জুগিয়েছে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোয় অনুষ্ঠিত গ্রুপ অব টোয়েন্টি বা জি২০ নেতাদের দুদিনের বৈঠক। সেখানে শেষ মুহূর্তে কর আরোপের পরিকল্পনা বিচ্ছিন্নভাবে আপত্তির মুখে পড়লেও বেশির ভাগ দেশ এর পক্ষে ছিল।
গত সোমবার রিও ডি জেনিরোর মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে জি২০ রাষ্ট্রপ্রধান এবং তাদের প্রতিনিধিদের স্বাগত জানানোর মাধ্যমে শুরু হয় শীর্ষ সম্মেলন। এতে বৈশ্বিক অসাম্য হ্রাস ও টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ব্রাজিলের নতুন কর আরোপের পরিকল্পনা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। বিশ্বনেতারা এ প্রস্তাব নিয়ে তর্কবিতর্ক করেছেন। কেউ কেউ একে সম্পদ বণ্টনে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন, আবার কেউ এর বাস্তবায়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
বৈঠকের আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় ব্রাজিলের পরিবেশমন্ত্রী মারিনা সিলভা বলেন, ‘জলবায়ু এজেন্ডা, অর্থনৈতিক এজেন্ডা ও বিশেষ করে অতিধনীদের ওপর করসংক্রান্ত কিছু আপত্তি রয়েছে।’ মারিনা সিলভা এও জানান, একটি সম্মিলিত ঘোষণায় পৌঁছার চেষ্টা করবেন তারা।
এর আগে জুলাইয়ে রিওতে আরেক বৈঠকে মিলিত হন জি২০ দেশের অর্থমন্ত্রী ও প্রতিনিধিরা। তখন প্রথমবারের মতো তারা স্বীকার করেন যে সম্পদ এবং আয়ের বৈষম্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক সংহতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। যৌথ ঘোষণায় তারা বলেন, ‘উচ্চ নিট সম্পদশালী ব্যক্তিদের কার্যকরভাবে করের আওতায় আনতে পরস্পরকে সহযোগিতা করা উচিত।’
অবশ্য কোন দেশগুলোর আপত্তি তুলেছে তা প্রকাশ করেননি পরিবেশমন্ত্রী মারিনা সিলভা। তবে জানা গেছে, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মাইলি এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে ২০টি দেশের যৌথ বিবৃতির শব্দ প্রয়োগে পরিবর্তন আনতে পারে ব্রাজিল। এমনও হতে পারে ১৯টি দেশের পক্ষ থেকে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করা হতে পারে, যেখানে আপত্তি উত্থাপনকারী দেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করে আলাদা অনুচ্ছেদ থাকবে বলে আলোচনায় যুক্ত একটি সূত্র গতকাল জানিয়েছিল।
এরই মধ্যে জি২০-তে নারীর ক্ষমতায়নের মন্ত্রী পর্যায়ের ঘোষণায় স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেছে আর্জেন্টিনা। এছাড়া আজারবাইজানের বাকুতে চলমান কপ২৯ জলবায়ু সম্মেলনের তৃতীয় দিনে দেশটি বৈঠক থেকে সরে গেছে।
কর আরোপের প্রস্তাবে স্পেন, ফ্রান্স ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে ব্রাজিলের প্রধান সমর্থক হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ দেশগুলো অন্য নেতাদের ওপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাতে চাপ দিচ্ছে।
গত সোমবার লন্ডনে জোটভুক্ত দেশের উদ্দেশে স্পেনের অর্থমন্ত্রী কার্লোস কুয়ের্পো বলেন, ‘এমন একটি মুহূর্ত আসে, যখন আপনাকে সাহসী হতে হয় এবং যা সঠিক বলে মনে করেন তা করতে হয়।’
তার মতে, গত কয়েক বছরে বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নাগরিকদের পক্ষে আসা দাবির মধ্যে রয়েছে সম্পদের পুনর্বণ্টন। তাই সরকারগুলোকে কোনো না কোনোভাবে এর জবাব দিতে হবে।
কার্লোস কুয়ের্পো এর আগে জোর দিয়ে বলেছিলেন, জি২০ দেশের প্রথম পদক্ষেপ হবে আন্তর্জাতিকভাবে অতিধনী হিসেবে বিবেচিত ব্যক্তিদের আয় ও সম্পদের একটি ডাটাবেস তৈরি করা।
বিশ্বের তিন হাজার শীর্ষ ধনী ব্যক্তির ওপর কর আরোপের বিষয়ে গত বছর ফরাসি অর্থনীতিবিদ গ্যাব্রিয়েল জুকম্যান একটি প্রস্তাব তৈরি করেন। এর ওপর ভিত্তি করে উন্নত দেশগুলোর পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। গ্যাব্রিয়েল জুকম্যানের যুক্তি অনুসারে, বর্তমানে অতিধনীরা সম্পদের দশমিক ৩ শতাংশের সমপরিমাণ কর দিয়ে থাকেন। বিশ্বব্যাপী প্রায় তিন হাজার ব্যক্তির কাছ থেকে প্রতি বছর ২ শতাংশ হারে কর পেলে এ বাবদ অর্থের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ২০-২৫ হাজার কোটি ডলার। এ অর্থ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মতো তহবিলে দেয়া যেতে পারে।
অর্থমন্ত্রীদের বৈঠকের আগে প্রকাশিত অলাভজনক সংস্থা অক্সফামের বিশ্লেষণ অনুসারে, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ গত এক দশকে ৪২ ট্রিলিয়ন ডলারের মতো সম্পদ অর্জন করেছেন, যা অর্থনৈতিক বিবেচনায় বিশ্বের মোট জনসংখ্যার নিচের ৫০ শতাংশ থেকে প্রায় ৩৬ গুণ বেশি।
পরিসংখ্যানে আরো দেখা যাচ্ছে, জি২০ দেশের শীর্ষ ১ শতাংশ ব্যক্তিরা এখন মোট সম্পদের ৩১ শতাংশের মালিক, যা দুই দশক আগে এক-চতুর্থাংশের বেশি বা ২৬ শতাংশ ছিল।
রিও সম্মেলনের আগে অক্সফাম ব্রাজিলের নির্বাহী পরিচালক ভিভিয়ানা সান্তিয়াগো বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অতিধনীদের কর এড়ানো বন্ধ করার সুযোগ রয়েছে রিও সম্মেলনের নেতাদের। এ পদক্ষেপ নেয়া গেলেই আমরা সমাজে বিদ্যমান অসাম্য দূরে পদক্ষেপ নেয়া শুরু করতে পারব।’ (খবরঃ ইউরো নিউজ)।
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন