জার্মানির নাগরিকরা আগের মতো নগদ অর্থে কেনাকাটা না করলেও এখনও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশগুলোর ক্রেতাদের তুলনায় বেশি নোট ও কয়েন ব্যবহার করে থাকেন। গত সোমবার প্রকাশিত একটি বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের (বিসিজি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে জার্মানির বাসিন্দারা মাথাপিছু গড়ে ৩০৪টি ইলেক্ট্রনিক পেমেন্ট, অর্থাৎ, কার্ড ব্যবহার করে কেনাকাটা করেছেন। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর তথ্যের ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে।
বিসিজির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এর ফলে জার্মানিতে ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড ও স্মার্টফোনের ব্যবহার তৃতীয় স্থানে নেমে এসেছে। নরওয়েতে মাথাপিছু সর্বাধিক ইলেকট্রনিক পেমেন্টের লেনদেন ছিল। নরওয়েতে প্রত্যেক ব্যক্তি গড়ে ৮১৫, লুক্সেমবুর্গ ৭৫৩, আয়ারল্যান্ড ৭০৫ ও ডেনমার্ক ৬৭৫ বার করে ইলেক্ট্রনিক পেমেন্ট করেছেন। ওদিকে ইতালির ভোক্তারা ১৯৪, মাল্টা ২৪৩, স্পেন ২৮৮ ও অস্ট্রিয়ায় গত বছর মাথাপিছু ৩০০টি করে ইলেক্ট্রনিক পেমেন্ট করে জার্মানির পেছনে অবস্থান করছে।
এর মাঝেই জার্মানিতে নগদ অর্থের লেনদেন হ্রাস পাচ্ছে। ২০০৮ সালে, দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বুন্ডেসব্যাংকের বার্ষিক সমীক্ষা অনুসারে নগদ ব্যবহারের হার ছিল ৮৩ শতাংশ। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে এই হার ১ শতাংশে নেমে এসেছে। বিসিজির আর্থিক বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, আগামী বছরগুলোয় ইলেক্ট্রনিক পেমেন্ট পদ্ধতির অংশ বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধি পেতে থাকবে। তবে ক্রেডিট কার্ড সংস্থাগুলে, পেমেন্ট পরিষেবা সরবরাহকারী, পেমেন্ট অ্যাপ সরবরাহকারী ও ব্যাংকগুলোর লাভের পরিমাণ কমে আসবে। গ্রুপটি গত বছর বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংস্থাগুলোর আয় ১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার অনুমান করেছে, যা গত পাঁচ বছরে ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিসিজি পূর্বাভাস অনুসারে, ২০২৮ সালের মধ্যে, এটি ৫ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধিতে নেমে যেতে পারে, কারণ বৈদ্যুতিক অর্থপ্রদানের বাজার তার সীমার কাছাকাছি।
ইউরোপে অর্থনীতির ইঞ্জিন বলে খ্যাত এই দেশটিতে ‘ক্যাশ ওনলি’ জনপ্রিয়। নাগরিকদের কাছে নগদের যে উষ্ণতা রয়েছে, তা প্লাস্টিক পেমেন্টে নেই। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত একটি জরিপ বলছে, জার্মানদের মানিব্যাগে গড়ে ১০৩ ইউরো থাকে- যা ইউরোপের অন্য যে কোনো দেশের অধিবাসীদের চেয়ে বেশি। স্ট্যাটিস্টা গবেষণা সংস্থার বিবরণ অনুযায়ী, জার্মানিতে যাবতীয় কেনাবেচার ৮০ শতাংশই ঘটে নগদে; সে তুলনায় ফ্রান্সে ৬৮ শতাংশ ও নেদারল্যান্ডসে মাত্র ৪৬ শতাংশ।
২০০২ সালে ইউরো মুদ্রা বাজারে আসার আগ পর্যন্ত জার্মানির বুন্ডেসব্যাংক একা যত নোট ইস্যু করেছে, তা বাকি সব ইউরো দেশগুলের সামগ্রিকভাবে ইস্যু করা নোটের চেয়ে বেশি। অন্যদিকে জার্মানিতে কার্ড টার্মিনালের সংখ্যা ইউরোপের অন্য যেকোনো মুখ্য অর্থনীতির চেয়ে কম। জার্মানরা যে শুধু নগদপ্রেমী, শুধু তাই নয়, দৃশ্যত তারা কার্ডের প্রতি বিরূপ। ইসিবির ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরের একটি রিপোর্ট বলছে, ২০১৬ সালে জার্মানিতে নগদ বাদ দিয়ে যতো পেমেন্ট হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র ১৯ শতাংশ ছিল কার্ডে, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য সব দেশের চেয়ে কম। যেমন ব্রিটেন কিংবা ফ্রান্সে নগদবিহীন লেনদেনের ৫৩ ও যথাক্রমে ৬৫ শতাংশ হয় কার্ডে।
জার্মানরা কেন নগদ ভালোবাসেন, তার নানারকম ব্যাখ্যা রয়েছে – বিশেষ করে ভাইমার প্রজাতন্ত্রের আমলে (ত্রিশের দশকের শেষে) জার্মানিতে যে হাইপার ইনফ্লেশন বা মাত্রাধিক মূল্যস্ফীতি ঘটেছিল, তা জার্মান মানসে চিরকালের দুঃস্বপ্ন হয়ে রয়েছে। অন্যরা বলেন, নাৎসি রাষ্ট্রের বিভীষিকার পর জার্মানরা তাদের ব্যক্তিগত জীবনকে গোপনে রাখতে ভালোবাসেন- অর্থ যার অঙ্গ। মেশিনে কার্ড ঢোকালে ব্যক্তিগত তথ্যগুলো বাজারিদের হাতে গিয়ে পড়তে পারে, এই আতঙ্কে ভোগেন জার্মানরা। পকেটে নগদ থাকার মানে স্বাধীন থাকা, পরনির্ভর না পরমুখাপেক্ষী না হওয়া।
এছাড়া সাশ্রয়ী হওয়াটা জার্মান মূল্যবোধের অঙ্গ। অঋণী থাকা, খরচ খরচার ব্যাপারে সাবধান হওয়াটা এখানে একটি চারিত্রিক গুণ বলে গণ্য করা হয়। মনে রাখতে হবে, ‘ধার’ কথাটির জার্মান হল ‘শুল্ড’, যার আরেক অর্থ ‘পাপ’!
সূত্র : ডয়চে ভেলে।
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন