সিন্ধু নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ছয় দশকের পুরনো চুক্তি ঘিরে আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক। ভারত সরকারের সাম্প্রতিক একতরফা চুক্তি স্থগিতের ঘোষণাকে ইসলামাবাদে ‘যুদ্ধের হুমকি’ হিসেবে ধরা হচ্ছে। দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশীর এ উত্তেজনায় দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন করে যুদ্ধাবস্থার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সিন্ধু চুক্তির পেছনের ইতিহাস ও বর্তমান উত্তেজনা
১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত সিন্ধু পানি চুক্তি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পানির অংশীদারত্ব নির্ধারণ করেছিল। চুক্তি অনুযায়ী, পশ্চিম দিকের তিনটি নদী— সিন্ধু, ঝেলম ও চেনাব পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত। আর পূর্বের রবি, বিয়াস ও শতদ্রু হচ্ছে ভারতের জন্য। ভারত এ চুক্তির আওতায় সীমিত হাইড্রো প্রকল্প নির্মাণের অনুমতি পেলেও, পানি প্রবাহের নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ ছিল এ চুক্তিতে।
তবে ২০২৫ সালের এপ্রিলে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হওয়ার পর পরিস্থিতির মোড় ঘুরে যায়। ভারত দাবি করে, হামলাটি পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠীর কাজ। আর এ ঘটনার পরপরই নয়াদিল্লি সিন্ধু চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেয়।
ভারত বলছে চুক্তি ‘স্থায়ীভাবে স্থগিত’
২১ জুন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা দেন, ‘সিন্ধু পানি চুক্তি স্থায়ীভাবে স্থগিত থাকবে, এটি আর পুনর্বহাল হবে না।’ ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এই সিদ্ধান্ত কেবল রাজনৈতিক বার্তা নয়। এর মাধ্যমে পাকিস্তানের ওপর চাপ তৈরির কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে।
এ ঘোষণার পরদিনই পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি সতর্ক করে জানায়, পানির প্রবাহ বন্ধ করার যেকোনো পদক্ষেপকে যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য বলে বিবেচনা করা হবে। এরপর মে মাসে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর চারদিনের সীমান্ত সংঘর্ষে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ব্যবহারের ঘটনা ঘটে। পরে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সাময়িক যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও এখনো উত্তেজনা কাটেনি।
ভারতের সীমাবদ্ধতা: ভূগোল ও আইন
বিশ্লেষকদের মতে, ভারত যদি সত্যিই পানি প্রবাহ বন্ধ করতে চায়, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে তা সম্ভব হবে না। কারণ সিন্ধু অববাহিকার নদীগুলো ভূগোলগতভাবে পাকিস্তানমুখী আর ভারতীয় ভূখণ্ডে পানি সংরক্ষণের অবকাঠামো সীমিত।
পাকিস্তানের পানি বিশেষজ্ঞ নাসির মেমন বলেন, ‘শীতকালে নদীর প্রবাহ কম থাকে। তখন ভারতের যেকোনো জলবিদ্যুৎ প্রকল্প পাকিস্তানের কৃষিতে প্রভাব ফেলতে পারে।’ বিশেষত, চেনাব নদীতে ভারত যে নতুন হাইড্রো প্রকল্প নির্মাণ করছে, সেগুলো নিয়ে ইসলামাবাদ বেশ চিন্তিত।
গ্রীষ্মকালে পানি প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় ভারতের নিজস্ব অঞ্চলেই বন্যার ঝুঁকি থাকে। তাই সে সময়টায় পানি আটকে রাখার কোনো কৌশল কাজ করে না।
পাকিস্তানের প্রস্তুতি: ঘাটতির পরও আগাম ভাবনা
পাকিস্তানে মাত্র তিনটি বড় জলাধার রয়েছে— টারবেলা, মাংগলা ও চাশমা। এগুলো দেশের পানির চাহিদা মাত্র ৩০ দিন পর্যন্ত মেটাতে পারে। যেখানে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, ন্যূনতম ১২০ দিন সংরক্ষণের সক্ষমতা থাকা উচিত।
এ ঘাটতি পূরণে পাকিস্তান দিয়ামির-ভাশা ও মোহমান্ধ বাঁধ নির্মাণ করছে। কিন্তু এগুলো আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। তবে এখনই পানি সংকট দেখা দিলে পাকিস্তানের হাতে বিকল্প খুব কম।
সামরিক না কূটনীতি?
পাকিস্তানের সাবেক পানি বিষয়ক মন্ত্রী আহমেদ ইরফান আসলামের মতে, এখন হয়তো ভারত পানি আটকে রাখতে পারবে না। কিন্তু ভবিষ্যতে এই সক্ষমতা অর্জনের দিকে দেশটি এগোচ্ছে। ভারত যখন একতরফা চুক্তি স্থগিত করছে, তখন পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় সমাধান চায়।
এমন প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আদালতে ভারতের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে। তবে ভারত আদালতের এই এখতিয়ার স্বীকার করতে নারাজ। এর ফলে আইনি প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ
পানি কেবল একটি প্রাকৃতিক সম্পদ নয়। এটি এখন রাজনৈতিক ও কৌশলগত হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ভারত-পাকিস্তান উভয়ের মধ্যে আস্থা কমে যাওয়ায়, সিন্ধু চুক্তির মতো দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্তও ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিস্থিতি যদি সামলানো না যায়, তবে দক্ষিণ এশিয়ায় পরিবেশগত সংকটের পাশাপাশি বড় ধরনের সামরিক সংঘর্ষও ঘটে যেতে পারে। তাই দুই দেশের পক্ষ থেকেই এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক দায়িত্বশীলতা ও কৌশলগত সংযম।
—আল জাজিরা থেকে
মন্তব্য করুন