গত ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক শুল্ক (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ) আরোপ হওয়ার পর বাংলাদেশ যত দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে ওয়াশিংটনে চিঠি পাঠিয়েছিল, শুল্ক কার্যকর তিন মাস স্থগিত করার পর বাংলাদেশের মধ্যে দরকষাকষির বিষয়ে ঢিলেঢালা ভার চলে আসে। তিন মাসের শুল্কবিরতি প্রায় শেষ হওয়ার প্রেক্ষাপটে সোমবার বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘নতুন ডকুমেন্টসে যুক্তরাষ্ট্র আমাদেরকে সামরিক সরঞ্জাম, বোয়িং, এলএনজি, গমসহ কৃষিপণ্য ও তুলা আমদানি আরও সহজ করার কথা বলেছে। আমরা ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম, তুলা ও এলএনজি আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। উড়োজাহাজ কেনার উদ্যোগও আছে।’ বাণিজ্য সচিব বলেন, ‘চুক্তি স্বক্ষর নিয়ে আলোচনা চলাকালে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে আমাদের চিঠি দেওয়া হতাশাজনক।’
আজ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার ফ্লাইটে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন জানিয়ে মাহবুবুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সময় ৮ তারিখ ও বাংলাদেশ সময় ৯ তারিখ সকালে পরবর্তী মিটিং হবে। সেই মিটিংয়ে তিনি সশরীর যোগ দেবেন। এদিকে ট্রাম্প পারস্পরিক শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার পর বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম সমস্ত মার্কিন পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে দরকষাকষি শুরু করে। অন্যদিকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের ১০০টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার ঘোষণার পর বাজেটে তা কার্যকর করেছে। কোন ১০০ পণ্যে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দিতে চায়, যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে তখন তালিকা চাওয়া হলেও বাজেটের আগে সেই তালিকা সরবরাহ করেনি ঢাকা।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, বাংলাদেশের পক্ষে দরকষাকষিতে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান সেখানে অবস্থান করছিলেন। ওই সময় ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে বার্তা পাঠিয়ে দরকষাকষির বিষয়ে আশ্বস্ত করা হয়। ২৬ জুন ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভের (ইউএসটিআর) সঙ্গে মিটিংয়ের আগে তিনি সরকারকে আভাস দেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষিতে বাংলাদেশ সবচেয়ে এগিয়ে আছে। ভিয়েতনামসহ কোনো দেশের পক্ষেই ৯ জুলাইয়ের আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছা সম্ভব নয়।
সূত্র জানায়, ওয়াশিংটন থেকে সরকার আরেকটি বার্তা পায়, যেখানে বলা হয়, ৩-৪ জুলাইয়ের দিকে ট্রাম্প প্রশাসন পারস্পরিক শুল্ক কার্যকর করার সময়সীমা এক বছর পর্যন্ত পিছিয়ে দিতে পারে। তাই দরকষাকষি চূড়ান্ত করে ৯ জুলাইয়ের আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশের আটকে পড়া ঠিক হবে না। এ কারণেই আলোচনায় ধীর গতিতে এগোনোর কৌশল নেয় ঢাকা।
এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আকর্ষণীয় কোনো প্রস্তাব ঢাকার পক্ষ থেকে উপস্থাপন না করে দেশটি বাংলাদেশের কাছে কোন কোন পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা চায়, তার একটি তালিকা চায় ঢাকা। গত রাতে বাংলাদেশের ওপর প্রস্তাবিত শুল্কহার ৩৫ শতাংশ নির্ধারণ করে দেওয়া চিঠির সঙ্গে সেই তালিকাসহ নতুন করে চুক্তির ডকুমেন্ট পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
সর্বশেষ মিটিংয়ে ঢাকা অনুরোধ করে, ৯ জুলাইয়ের মধ্যে চুক্তি সম্পন্ন না হলে যেন প্রস্তাবিত ৩৭ শতাংশ হারে শুল্কারোপ না হয় বাংলাদেশের ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত না জানিয়ে বলা হয়, ‘ইট মে বি নট, যেহেতু তোমরা নেগোসিয়েশনের মধ্যে আছ।’
৩ জুলাইয়ের মিটিংয়ে বাংলাদেশ এলডিসি হিসেবে শুল্ক কমানোর প্রস্তাব তুলে ধরে। তার পরিপ্রেক্ষিতে ইউএসটিআর কর্মকর্তারা বিবেচনার আশ্বাস দিলে বাংলাদেশ মনে করে যে, এলডিসিগুলোর জন্য শুল্কহার কম হবে। যেহেতু ভিয়েতনাম উন্নয়নশীল দেশ এবং বাংলাদেশ এলডিসি, তাই স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের শুল্কহার ভিয়েতনামের চেয়ে কম হবে।
তবে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) সাবেক সদস্য ড. মোস্তফা আবিদ খান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র কখনোই এলডিসিগুলোর জন্য বাড়তি কোনো সুবিধা দেয়নি। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার এলডিসি হওয়া সত্ত্বেও এই দুই দেশের উপর প্রস্তাবিত রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ রেট ভিয়েতনাম, চীন, ভারত, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। তাই এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ বাড়তি সুবিধা পাবে—এমনটি আশা করা যৌক্তিক নয়।’
উল্লেখ্য, ভিয়েতনামের ওপর ২০ শতাংশ, মিয়ানমার ও লাওসের ওপর ৪০ শতাংশ, মালয়েশিয়া ও তিউনিসিয়ার ওপর ২৫ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ওপর ৩২ শতাংশ, এবং কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের ওপর ৩৬ শতাংশ করে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষির জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসন-ঘনিষ্ঠ লবিষ্ট ফার্ম নিয়োগ দিতে তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ-র পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বলে টিবিএসকে জানিয়েছেন বাংলাদেশ চেম্বার অভ ইন্ডাস্ট্রিজ-এর সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ। কিন্তু সরকার সে ধরনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি বলে জানান তিনি।
বিজিএমইএর সাবেক এই সভাপতি বলেন, ‘ইউএসটিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ট্যারিফ কমানো বা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে সফলতা পাওয়া যাবে না। এজন্য আমরা লবিস্ট নিয়োগ দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছিলাম।’
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষিতে সফল হতে না পারার আরেকটি কারণ হলো, প্রস্তাবিত পারস্পরিক শুল্ক চুক্তিতে ওয়াশিংটন এমন কিছু শর্তারোপ করেছে, যা প্রচলিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্র্যাকটিস ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যেসব বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়, তাতে ২৬ জুনের সভায় রাজি হয়নি ইউএসটিআর।
৩ জুলাইয়ের মিটিংয়েও বাংলাদেশ জানায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া শর্তগুলো পালন করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডাব্লিউটিও) নিয়মের মধ্যে থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করতে চায় বাংলাদেশ। এ কথা বলার পরও যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র পরবর্তীতে বৈঠক করার ক্ষেত্রে সম্মতি দিয়েছে, তাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ধরে নিয়েছেন যে বাংলাদেশের প্রস্তাবে ইউএসটিআর রাজি হয়েছে।
২ এপ্রিল শুল্ক আরোপের প্রস্তাবের পর ৯ এপ্রিল ইউএসটিআরের সঙ্গে অনলাইনে বৈঠক করেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এরপর ২১ এপ্রিল ওয়াশিংটনে ইউএসটিআরের সঙ্গে এ নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের বৈঠক হয়। ওই সময় ইউএসটিআর ৬টি পয়েন্টে আলোচনার বিষয়ে সম্মত হয়। পরবর্তীতে ৪ জুন ফের ইউএসটিআরকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ। পারস্পরিক শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ১২ জুন একটি নন-ডিসক্লোজার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ, যার আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক শুল্ক চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হয় বাংলাদেশ। ১৭ জুন অনুষ্ঠিত অনলাইন মিটিংয়ে দুই দেশের মধে পারস্পরিক শুল্ক চুক্তি করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ঢাকা। পরে যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তির একটি খসড়া বাংলাদেশকে পাঠিয়েছে, যা নিয়ে এখনও দরকষাকষি চলছে।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত পারস্পরিক শুল্ক চুক্তিতে এমন শর্ত দেওয়া হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে বাংলাদেশকেও ওই দেশের উপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করলে বাংলাদেশকেও তা অনুসরণ করতে হবে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এমন একটি শর্তারোপ করা হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের যেসব পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ ছাড় দেবে, একই পণ্যের ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশকে ছাড় দেওয়া যাবে না। এটি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মোস্ট-ফেভার্ড ন্যাশন (এমএফএন) নীতির বিরোধী।
যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে দেশটি থেকে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। এরই অংশ হিসেবে সরকারিভাবে বোয়িং উড়োজাহাজ, এলএনজি, গম আমদানি বাড়ানো হচ্ছে। গত সপ্তাহে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান বাবু টিবিএসকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এই উদ্বেগ থেকেই ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে মিটিং করেছি। তিনি আমাদের পরামর্শ দিয়ে বলেছেন যে, আমাদের আরও সুনির্দিষ্ট, আরও সিরিয়াস হওয়া উচিত।’
মন্তব্য করুন