সমুদ্রতলের কেবল নিয়ে ‘স্নায়ুযুদ্ধ’ – The Finance BD
 ঢাকা     মঙ্গলবার, ০৮ Jul ২০২৫, ১২:৫০ পূর্বাহ্ন

সমুদ্রতলের কেবল নিয়ে ‘স্নায়ুযুদ্ধ’

  • ০৫/০৭/২০২৫

ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের দৌড়ে বিশ্বশক্তি ও টেক জায়ান্টরা
অনেকের ধারণা, ইন্টারনেট একধরনের অদৃশ্য জাল। বাতাসের মাধ্যমে ফোন থেকে তথ্য যায় ক্লাউডে, আবার ফিরে আসে যার যার ডিভাইসে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সমুদ্রের তলদেশে পাতা মোটা ফাইবার-অপটিক কেবল দিয়ে বিশ্বের ৯৫ শতাংশের বেশি ইন্টারনেট ট্রাফিক চলাচল করে। এ কেবলগুলো মহাদেশের পর মহাদেশকে সংযুক্ত করে রেখেছে। সমুদ্রতলের এসব কেবলই ইন্টারনেটের প্রকৃত মেরুদণ্ড। এসব স্থাপনা ঘিরেই সরকার ও বড় টেক কোম্পানিগুলোর মধ্যে এক নীরব দ্বন্দ্ব দেখা যাবে, যা এক ধরনের ক্ষমতার লড়াইও।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের তথ্যানুযায়ী, হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ, ব্যাংকিং লেনদেন, স্যাটেলাইট ডাটা, ভিডিও কল, এমনকি সামরিক যোগাযোগেরও মূলে রয়েছে এসব ফাইবার অপটিক কেবল। ফলে গোটা বিশ্বে অদৃশ্য স্নায়ুতন্ত্র হিসেবে ছড়িয়ে থাকা এ সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণ যার হাতে থাকবে, অন্যদের ওপর বড় ধরনের প্রভাব খাটানোর ক্ষমতাও তার বেশি হবে।
চীনভিত্তিক প্রযুক্তিবিষয়ক সংবাদমাধ্যম গিজচায়না সম্প্রতি সমুদ্রতলের ইন্টারনেট কেবল নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে বলা হচ্ছে, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো শুধু অ্যাপ বা সফটওয়্যারই বানাচ্ছে না। তারা তৈরি করছে ডিজিটাল মহাসড়ক। সে সড়ক কার অধীনে থাকবে, তা নিয়েই চলছে আধিপত্যের দ্বন্দ্ব। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে কীভাবে এসব কেবল এখন বৈশ্বিক প্রযুক্তি ও ভূরাজনীতির নীরব অথচ গুরুত্বপূর্ণ শক্তির লড়াইয়ের কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এফে ইউডিন বলছেন, ইন্টারনেটের শুরু থেকে দীর্ঘ সময় ধরে সমুদ্রতলের কেবল স্থাপনের কাজটি হতো মূলত টেলিকম কোম্পানি ও বিভিন্ন রাষ্ট্রের যৌথ উদ্যোগে। কিন্তু সে চিত্র এখন দ্রুত বদলে যাচ্ছে। বর্তমানে গুগল, মেটা, অ্যামাজন ও মাইক্রোসফটের মতো টেক জায়ান্টরা নিজেই সমুদ্রতলে কেবল বসাচ্ছে। গুগল এরই মধ্যে ২০টির বেশি আন্ডারসি কেবল প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ইকুইয়ানো’, যেটি পর্তুগাল থেকে নাইজেরিয়া হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত।
বড় টেক কোম্পানিগুলোর সমুদ্রতলে কেবল বসানোর বিষয়টি প্রথমে ইতিবাচক মনে হতো। অনেকের ধারণা, এতে মিলবে আরো দ্রুত ও সস্তা ইন্টারনেট। কিন্তু বিষয়টা শুধু উন্নয়ন নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন। টেক জায়ান্টরা অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে নিজেরাই সে অবকাঠামোর মালিক হয়ে উঠছে। অর্থাৎ কারা সংযুক্ত হবে, কত খরচ হবে, কোন পথে কোন তথ্য যাবে, সব ঠিক করার ক্ষমতা থাকবে এসব কোম্পানির হাতে।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ নাহলা ডেভিস বলছেন, টেক কোম্পানিগুলোর নিজস্ব সাবসি কেবল স্থাপনের প্রবণতা এখন শুধু দ্রুত ইন্টারনেট বা ব্যয় হ্রাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর মূল লক্ষ্য হলো তথ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তার।
এছাড়া বিভিন্ন দেশ এখন আন্ডারসি ইন্টারনেট কেবলগুলোকে জাতীয় নিরাপত্তার অংশ হিসেবে দেখছে। ভবিষ্যতে যুদ্ধ বা সংঘাতের সময় প্রতিপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে কেবল কেটে দিতে পারে বা এর মাধ্যমে গোপনে নজরদারি চালাতে পারে বলে উদ্বেগ বাড়ছে। নজরদারির ঝুঁকির আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা চীনা কোম্পানিগুলোর কেবল প্রকল্পে অংশগ্রহণ আটকে দিচ্ছে। অন্যদিকে চীনও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে নিজস্ব কেবল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে, যেন পশ্চিমা রুটের ওপর নির্ভরতা কমানো যায়।
যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. সিদ্ধার্থ কৌশল বলেন, কেবলগুলো দিয়ে যে বিপুল পরিমাণ বৈশ্বিক তথ্য আদান-প্রদান হয়, তা বিবেচনায় নিলে দেখা যায় দীর্ঘমেয়াদে কোনো ক্ষতি হলে প্রভাব অত্যন্ত গুরুতর হতে পারে। প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী একধরনের ‘ইন্টারনেট স্নায়ুযুদ্ধ’ শুরু হয়েছে। এখানে আস্থা, প্রবেশাধিকার ও কৌশলগত অবস্থান সবকিছুই বিবেচনায় আসছে।

ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

Leave a Reply




Contact Us