ডোনাল্ড ট্রাম্প আরোপিত উচ্চ শুল্কে সাময়িক স্থগিতের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ৯ জুলাই। রফতানির পথ থেকে কঠোর এ বাধা সরাতে এশিয়ার শিল্পপ্রধান দেশগুলো মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। কিছু দেশ দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বসলেও সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি মেলেনি। এমন পরিস্থিতিতে এশিয়ার রফতানিকারকরা কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করেছেন। স্বল্পমেয়াদে তারা দ্রুত ক্রয়াদেশ সরবরাহের পাশাপাশি পণ্যের দাম কমাচ্ছেন। একই সঙ্গে নতুন ক্রেতা খোঁজার পাশাপাশি বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবছেন। খবর এফটি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প আরোপিত ১০ শতাংশ সর্বজনীন শুল্ক এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানিনির্ভর দেশগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এমন পরিস্থিতিতে স্থগিত হওয়া রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বাস্তবায়ন হলে দেশগুলোর সামনে কঠিন সময় আসতে পারে। এরই মধ্যে রফতানিনির্ভর টেক্সটাইল, ইলেকট্রনিকস ও গাড়ির যন্ত্রাংশ উৎপাদকরা বাজার অস্থিরতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। নাইকি ব্র্যান্ডের মোজা সরবরাহ করে পাকিস্তানের অন্যতম বড় পোশাক রফতানিকারক ইন্টারলুপ। কোম্পানিটি বছরে প্রায় ২২ কোটি ডলারের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায়। নাইকির প্রায় ৪০ শতাংশ মোজার পাশাপাশি খুচরা বিক্রেতা টার্গেটের জন্য ব্র্যান্ডেড পোশাক তৈরি করে ইন্টারলুপ। ট্রাম্পের ১০ শতাংশ সর্বজনীন শুল্ক আরোপের পর ইন্টারলুপকে টার্গেটের জন্য দাম কমাতে হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যের ওপর ২৯ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি ভয়াবহ হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন ইন্টারলুপের সিইও মুসাদাক জুলকারনাইন। তিনি জানান, দীর্ঘমেয়াদি গ্রাহকদের অনেকে ১২-১৮ মাস পর্যন্ত শুল্ক ধাক্কা সহ্য করতে পারবেন। এরপর কী হবে তা অনিশ্চিত। অবশ্য পাকিস্তানে কতটা পণ্য উৎপাদন হবে তা শুধু ইসলামাবাদের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চুক্তির ওপর নির্ভর করছে না। বরং বাংলাদেশের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী পোশাক রফতানিকারক দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কী ধরনের চুক্তিতে যাবে তার ওপরও নির্ভর করবে। যদি ঢাকার ওপর কম শুল্ক ধার্য করা হয়, ইন্টারলুপ হয়তো বাংলাদেশের বন্ধ কারখানা চালু করবে। এরই মধ্যে মিসরে নতুন একটি কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে ইন্টারলুপ। কারণ দেশটি মাত্র ১০ শতাংশ শুল্কের আওতায় পড়বে।
ইউরোপ ও রাশিয়ায় নতুন ক্রেতার সন্ধান চলছে বলেও জানিয়েছে ইন্টারলুপ। তবে কম খরচে পণ্য সরবরাহকারী চীনা প্রতিযোগীদের নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। মুসাদাক জুলকারনাইন বলেন, ‘যদি চাহিদা কমে যায়, তাহলে আমরা হয়তো কর্মীদের দুই-তিন মাস ছুটিতে পাঠিয়ে টিকতে পারব। এরপর ছাঁটাই হতে পারে।’ ২০১৬ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসে বিক্রয় অফিস খোলে চীনা কোম্পানি চার্মিং এলইডি। এর পরের বছর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে চীনের ওপর শুল্ক আরোপ হলেও কোম্পানিটি বড় ধাক্কা খায়নি। এখনো সেই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে এলইডি ল্যাম্প আমদানির ৯৫ শতাংশ জোগান দেয় চীন।
চীন-মার্কিন শুল্ক বিবাদ সাময়িক চুক্তিতে গড়ালেও চীনের ওপর এখনো মোট শুল্ক ৫৫ শতাংশ। চার্মিং এলইডির পণ্য এফওবি (ফ্রি অন বোর্ড) ভিত্তিতে রফতানি হয়। এ কারণে পণ্য বন্দরে পৌঁছানোর পর লজিস্টিকস ও শুল্কের দায় গ্রাহকের। আবার কিছু পণ্য গ্রাহকরা উৎস গোপন করে আমদানি করে। ওয়াং চেংমিংয়ের মন্তব্য, ‘যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্ব আগের মতো নেই। এটা এখন শুধু বাজারের একটা অংশ। যুক্তরাষ্ট্র মানেই পুরো বিশ্ব নয়।’
এদিকে শুল্কের সরাসরি লক্ষ্য স্যামসাং ও চীনা স্মার্টফোন নির্মাতাদের জন্য চিপ সরবরাহকারী দক্ষিণ কোরিয়ার ডংউন আনাটেক। কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট হুমকি দিয়েছেন, উৎপাদন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিস্থাপন না করলে অ্যাপল ও স্যামসাংয়ের ডিভাইসে ২৫ শতাংশ শুল্ক বসবে। ডংউন আনাটেকের সিইও কিম ডং-চল জানান, স্যামসাং এখনো দাম কমাতে বলেনি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক বাস্তবায়ন করলে তারা বলবে। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ায় কঠোর শ্রম আইন থাকায় খরচ কমানো কঠিন। তাই বিকল্প বাজার হিসেবে চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপে জোর দিচ্ছেন তারা। তবে দাম কমানোর চাপ শুধু স্যামসাং থেকে আসবে এমন নয়। হুন্দাই ও কিয়ার মতো গ্রাহকদের কাছ থেকেও আসবে। তাই কম শুল্ক ঝুঁকিতে থাকা কোম্পানি ও দেশের কাছে বিক্রি বাড়াতে চায় ডংউন আনাটেক। ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ৪৬ শতাংশ শুল্ক ঘোষণা করেন তখন ভিয়েতনাম থেকে কফির একটি চালান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের পথে। এতে সরবরাহকারী ভুয়ং থান কং হোল্ডিং ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়ার আশঙ্কায় ছাড় দিয়ে ক্ষতি মেনে নেয়।
চীনমুখী সরবরাহ চেইন থেকে বেরিয়ে আসতে অনেক কারখানা ভিয়েতনামে স্থানান্তরিত হলেও এখন দেশটি ট্রাম্পের শুল্কলক্ষ্য। ভুয়ং থান কংয়ের রফতানির প্রায় অর্ধেকই যুক্তরাষ্ট্রে যায়। কোম্পানির সিইও নগুয়েন ভান হিয়েপ জানান, ভবিষ্যতেও মার্কিন বাজারে প্রবেশ ধরে রাখতে ছাড় দিতে হবে। ৪৬ শতাংশ শুল্ক স্থায়ী হলে মাসিক মুনাফা ১৫ শতাংশ কমে যাবে। বিকল্প হিসেবে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ, তবে একমাত্র বাজার নয়।’
বিশ্বজুড়ে ১৫টি দেশে কারখানা রয়েছে জাপানি অটো যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী এনওকের। শুল্ক ও সরবরাহ সংকট সামাল দিতে গ্রাহকদের বিকল্প কারখানার খোঁজ দিচ্ছে তারা। এনওকের সিইও মাসাও তসুরু বলেন, ‘আমাদের প্রতিযোগীদের যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা নেই। তাই তারা জাপান, মেক্সিকো, কানাডা বা চীন থেকে রফতানি করে। আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকেও জোগান দিতে পারি, এতে অর্ডার বাড়তে পারে।’
এনওকে সরবরাহ চেইন সম্প্রসারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের দিকেও নজর দিচ্ছে। তারা ভারী যন্ত্রপাতি, সেমিকন্ডাক্টর ও জ্বালানি খাতে প্রবেশ করতে চায়। সেই সঙ্গে শুল্কে ক্ষতিগ্রস্ত কোম্পানিকে কিনে তাদের মার্কিন সরবরাহ চেইনে যুক্ত করার চেষ্টা করছে।
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন