কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ৬০ বছর পূর্তি গতকাল উদযাপন করেছে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। তবে এশিয়ার শক্তিধর এ দুই প্রতিবেশী ও প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের সম্পর্ক এখনো অতীতের চাপা ক্ষোভ ও নতুন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ঘেরা বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা। ১৯১০-৪৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়াকে জাপানের ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাস আজও দুই দেশের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সম্পর্ক উন্নতির দিকে গেছে, তবে দুই দেশই এখন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দ্বিপক্ষীয় ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের মুখোমুখি।
দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ং ক্ষমতায় এসেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ইউন-সুক ইওলের নীতির বিপরীতে অবস্থান নিয়ে। ইউন বর্তমানে সামরিক আইন জারির ঘটনায় অভ্যুত্থান চেষ্টার অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি। তবে কূটনীতিতে লি নিজেকে বাস্তববাদী বলে পরিচয় দেন এবং জাপান নিয়ে সাবেক সরকারের কিছু পদক্ষেপ তিনি অব্যাহত রাখতে পারেন বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।
ইউন ক্ষমতা ছাড়ার আগে জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেছিলেন। ২০২৩ সালে তিনি কোরীয় জোরপূর্বক শ্রমিকদের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া নিজেই ক্ষতিপূরণ দেবে বলে ঘোষণা দেন। যদিও এটি দেশের ভেতরে সমালোচনার জন্ম দেয়, কারণ ক্ষতিগ্রস্তরা প্রত্যক্ষভাবে জাপানি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ ও নতুন দুঃখ প্রকাশের দাবি জানিয়েছিলেন।
এমন উদ্যোগ ব্যবসা ও পর্যটনের ক্ষেত্রে কিছুটা ইতিবাচক ফল দিলেও দক্ষিণ কোরিয়ায় অনেকেই মনে করেন, জাপান যথাযথভাবে কূটনৈতিক ছাড়ের জবাব দেয়নি। লি জে মিয়ং অতীতে জাপানকে তার সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব না ছাড়ার জন্য দায়ী করেছেন এবং এটিকেই সহযোগিতার পথে বড় বাধা হিসেবে দেখেন।
আগামী ১৫ আগস্ট দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে লির বক্তব্যে ইতিহাস ইস্যু আবার সামনে আসতে পারে বলে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা। দক্ষিণ কোরিয়ায় অনেকেই চাচ্ছেন জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা ওইদিনে জোরালোভাবে দুঃখ প্রকাশ করবেন। তবে বর্তমান বাস্তবতা আরো গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির আওতায় নতুন শুল্ক আরোপ দুই দেশের রফতানিনির্ভর অর্থনীতির জন্য হুমকি তৈরি করছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদপত্র হানকিওরেহ এক সম্পাদকীয়তে দুই দেশকে ট্রাম্পের নীতির বিরুদ্ধে যৌথ প্রতিক্রিয়া জানাতে আহ্বান জানিয়েছে।
এদিকে টোকিওতে ৬০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা দুই দেশের সম্পর্কের ‘উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ’-এর আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘কম জন্মহার ও জনসংখ্যা হ্রাসের মতো সমস্যা মোকাবেলায় জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’
জি৭ সম্মেলনের সময় লি ও ইশিবার প্রথম বৈঠক ইতিবাচক ছিল। লি সেখানে বলেন, ‘আমরা একই উঠানের প্রতিবেশী, আমাদের ভবিষ্যৎমুখী সম্পর্ক গড়তে হবে।’ উভয় নেতা পারমাণবিক ইস্যু, বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে একযোগে কাজ করার বিষয়ে একমত হন। তবে ইতিহাস এখনো দুই দেশের সম্পর্কের পথে বাধা হয়ে আছে। ১৯৬৫ সালের এক চুক্তিতে জাপান দক্ষিণ কোরিয়াকে ৫০ কোটি ডলার অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়েছিল এবং জানিয়েছিল যুদ্ধকালীন ক্ষতিপূরণের সব বিষয় চূড়ান্তভাবে মিটে গেছে। কিন্তু এখনো জোর করে শ্রমিক নিয়োগ ও ‘কমফোর্ট উইমেন’ ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে টানাপড়েন রয়ে গেছে।
জাপান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। আর তা হলো লি কি তার আগের প্রেসিডেন্টের মতো মিশ্র কূটনৈতিক পথে হাঁটবেন, নাকি আগের উদারপন্থী সরকারের মতো কড়া অবস্থানে ফিরবেন। এদিকে এশিয়ায় নিরাপত্তা সংকট বাড়ছে আর ট্রাম্পের শুল্কনীতি মুক্ত বাণিজ্যে বাধা তৈরি করছে। এ প্রেক্ষাপটে জাপানের শীর্ষ দৈনিক ইয়োমিউরি এক সম্পাদকীয়তে লিখেছে, ‘জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার একসঙ্গে কাজ করা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি জরুরি।’ —এপি অবলম্বনে
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন