ইসরায়েল-ইরান সংঘাতে বন্ধ আকাশসীমা: মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে অনেক বিমানবন্দর বন্ধ ঘোষণা – The Finance BD
 ঢাকা     শুক্রবার, ২৭ Jun ২০২৫, ০৮:০৬ পূর্বাহ্ন

ইসরায়েল-ইরান সংঘাতে বন্ধ আকাশসীমা: মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে অনেক বিমানবন্দর বন্ধ ঘোষণা

  • ১৭/০৬/২০২৫

ইসরায়েল তার প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বেন গুরিয়ন বন্ধ ঘোষণা করেছে। ফলে ৫০ হাজারের বেশি ইসরায়েলি যাত্রী বিদেশে আটকে পড়েছেন।
আইমাল হোসেইন ইরানের কোম প্রদেশের একটি হোটেলেই উঠেছিলেন। ইসরায়েল যেদিন ইরানে আঘাত হানে সেদিন তার হোটেলের সামনেও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর থেকে আইমাল নিজ দেশে ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে আছেন। কিন্তু ইরানি আকাশসীমা চলাচলের জন্য সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আইমালের মতো অনেকেই ইরানে আটকে পড়েছেন। রোববার হামলার পর আইমাল কোম থেকে পালিয়ে তেহরানে আসেন। কিন্তু ইরান-ইসরায়েল সংঘাত আরও তীব্র হয়ে ওঠায় কোনো ট্যাক্সি তাকে সীমান্ত পর্যন্ত নিতে রাজি হচ্ছে না। গতকাল সোমবার মোবাইল ফোনে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বিমান, বাজার—সব কিছু বন্ধ। এখন আমি একটি ছোট হোটেলের বেজমেন্টে থাকছি। আমি ট্যাক্সিতে সীমান্তে পৌঁছাতে চেষ্টা করছি, কিন্তু এখন ট্যাক্সিও পাওয়া যাচ্ছে না, আর কেউ আমাদের নিতে চাচ্ছে না।’
শুক্রবার ইরানের রাজধানী তেহরানসহ বিভিন্ন স্থানে বড় ধরনের হামলা চালায় ইসরায়েল। এ হামলায় জ্যৈষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা, পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হন এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস হয়। লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে ছিল কোম শহর থেকে প্রায় ১৮ মাইল দূরে একটি পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র। এর জবাবে, ইরান শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। টানা কয়েক দিনের পাল্টাপাল্টি হামলায় দুই চিরশত্রু ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে উত্তাল সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায় উন্মোচিত হয়েছে। প্রতিরাতেই আকাশজুড়ে হামলার ঢেউ দেখে এই অঞ্চলের অনেকেই এখন একটি বৃহত্তর সংঘাতের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন।
এই সংঘাতের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশ তাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে। ডজনেরও বেশি বিমানবন্দর সব ধরনের ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে বা কার্যক্রম গুরুতরভাবে সীমিত করেছে, যার ফলে হাজার হাজার যাত্রী আটকে পড়েছেন, এবং অনেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা থেকে পালাতে বা নিজ দেশে ফিরতে পারছেন না। বিমানবন্দর বন্ধের কারণে সৃষ্টি হয়েছে ‘ভয়াবহ’ ডোমিনো প্রভাব, লাখো যাত্রী আটকে পড়েছেন
‘এখানে ডোমিনো প্রভাবটা বিশাল,’ বলেন অবসরপ্রাপ্ত পাইলট ও বিমান চলাচল নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জন কক্স। তিনি বলেন, এই বিশৃঙ্খলার ফলে বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে। কক্স বলেন, ‘হঠাৎ করে হাজার হাজার যাত্রী এমন জায়গায় আটকে পড়েছেন, যেখানে তাদের থাকার কথা নয়। ফ্লাইট ক্রু এবং বিমানগুলোও ভুল জায়গায় অবস্থান করছে।’ নিউইয়র্ক থেকে ইসরায়েলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা এল আল এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে ছিলেন ৫০ বছর বয়সী জভিকা বার্গ। অবতরণের সময় হঠাৎ পাইলট জানালেন, ‘দুঃখিত, আমাদের গন্তব্য পরিবর্তন করে লারনাকায় নামতে বলা হয়েছে।’ বার্গ দেখলেন, বার্লিনসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আসা আরও কয়েকটি এল আল ফ্লাইটও সাইপ্রাসের এই লারনাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করছে। এখন তিনি লারনাকার একটি হোটেলে অবস্থান করছেন, আর জেরুজালেমে থাকা স্ত্রীকে ফোনে জানাচ্ছেন পরিস্থিতি। বার্গ বলেন, ‘আমি ভাবছি, এখন কী করব।’
ইসরায়েল তার প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বেন গুরিয়ন বন্ধ ঘোষণা করেছে। ফলে ৫০ হাজারের বেশি ইসরায়েলি যাত্রী বিদেশে আটকে পড়েছেন। দেশটির তিনটি এয়ারলাইন্সের বিমানের বহর সাইপ্রাসের লারনাকায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এদিকে, তেল আবিবে মাহালা ফিঙ্কলম্যান একটি হোটেলে আটকে পড়েছেন। এয়ার কানাডার ফ্লাইট বাতিল হওয়ার পর, তিনি পরিবারের উদ্বিগ্ন সদস্যদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা বিস্ফোরণের শব্দ শুনি। মাঝে মাঝে কাঁপনও লাগে। সত্যি বলতে, আমি মনে করি সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো… পরে টেলিভিশনে যখন দেখি, তখন বুঝি আমাদের মাথার ওপর ঠিক কী ঘটেছিল, যখন আমরা নিচে বাঙ্কারে লুকিয়ে ছিলাম।’
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় দেশটির নাগরিকদের সতর্ক করেছে, যাতে তারা জর্ডান ও মিশরের সঙ্গে খোলা থাকা তিনটি সীমান্তপথ দিয়ে দেশ ছাড়ার চেষ্টা না করেন। যদিও এসব দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে, তথাপি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই দেশগুলো ইসরায়েলি নাগরিকদের জন্য ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হুমকি’ হিসেবে বিবেচিত। এদিকে, শুক্রবার ইরান তেহরানের উপকণ্ঠে অবস্থিত খোমেনি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সব ধরনের ফ্লাইট বাতিল করেছে। আর শনিবার ইসরায়েল দাবি করে, তারা তেহরানের মেহরাবাদ বিমানবন্দরে হামলা চালিয়েছে। বিমানবন্দরটি ইরানের বিমানবাহিনী এবং অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যিক ফ্লাইটের জন্য ব্যবহৃত হয়।
অনেক শিক্ষার্থী এখন ইরান, ইরাকসহ বিভিন্ন দেশে আটকে পড়েছেন
আটকে পড়াদের একজন, ভারতীয় মেডিকেল শিক্ষার্থী আসলান আহমেদ, তেহরানে অবস্থান করছেন। তিনি বলেন, তিনি এবং অন্যান্য শিক্ষার্থীরা হোস্টেল ছেড়ে বের হচ্ছেন না, চারপাশের চলমান হামলা দেখে আতঙ্কে রয়েছেন এবং কবে নিরাপদে ফিরতে পারবেন, তা জানেন না। আহমেদ বলেন, ‘টেলিভিশনে যা দেখি, তা খুবই ভয়ের। কিন্তু এর চেয়েও ভয়ঙ্কর হলো কিছু বধির করে দেওয়া বিস্ফোরণের শব্দ।’
ইরানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের তুলনামূলক নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক উদ্ধার পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়নি। এদিকে, লেবানন ও জর্ডানে আকাশসীমা সাময়িকভাবে খোলা থাকলেও, বিমানবন্দরে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে। ফ্লাইট বাতিল বা বিলম্ব হওয়ায় বহু যাত্রী দেশ-বিদেশে আটকে পড়েছেন। অনেক এয়ারলাইন্স ফ্লাইট সংখ্যা কমিয়েছে বা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে, এবং কর্তৃপক্ষ রাতের বেলায় হামলার সময়ে বিমানবন্দর বন্ধ করে দিচ্ছে। সিরিয়ায় নতুন নেতৃত্ব আসার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বিমানবন্দরগুলো সংস্কার করে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে শুরু করেছিল, এই সংঘাতের কারণে আবারও তা বাধার মুখে পড়েছে। ইরানের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ইরাক তাদের সব বিমানবন্দর বন্ধ করে দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল ইরানে হামলার জন্য আংশিকভাবে ইরাকি আকাশসীমা ব্যবহার করেছে, অন্যদিকে ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের দিকে যাওয়ার পথে ইরাকের আকাশেই ভূপাতিত হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বিদেশে অবস্থানরত নিজ দেশের নাগরিকদের সহায়তার জন্য বাগদাদ তুরস্কের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে, যার আওতায় তারা তুরস্কে যেতে পারবেন এবং সেখান থেকে সড়কপথে ইরাকে ফিরতে পারবেন—উভয় দেশের সীমান্তপথ ব্যবহার করে। ইরানে আটকে পড়া কিছু ইরাকি নাগরিক স্থল পথে দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কলেজ শিক্ষার্থী ইয়াহিয়া আল-সুরাইফি ও আরও কয়েকজন ইরাকি শিক্ষার্থী মিলে ট্যাক্সি চালকদের রাতভর ২০০ মাইল (৩২০ কিলোমিটার) দূরত্বে উত্তরের ইরাক সীমান্ত পর্যন্ত যাওয়ার জন্য অর্থ জোগাড় করেন, যদিও তাদের চারপাশে ড্রোন ও বিমান হামলা চলছিল। আল-সুরাইফি বলেন, ‘রাতের আকাশে এটা যেন আতশবাজির মত দেখাচ্ছিল। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম।’ সীমান্তে পৌঁছানোর পর তারা উত্তরের ইরাকি শহর ইর্বিলে পৌঁছালে, তার নিজের গৃহনগরী দক্ষিণ ইরাকের নাসিরিয়াহ যেতে এখনও আরও ৪৪০ মাইল (৭১০ কিলোমিটার) যেতে হয়। তেহরানে অবস্থানরত আইমাল হুসেইন বলেন, এই সংঘাত তাকে আফগানিস্তানের ২০ বছরের যুদ্ধের কষ্টকর স্মৃতিগুলো ফিরিয়ে এনেছে। তিনি বলেন, ‘এই কঠিন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে দ্বিতীয়বারের মতো আটকে পড়লাম। একবার কাবুলে, আর এবার ইরানে।’

ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

Leave a Reply




Contact Us