শুধু স্কুটারে নয়, ভবিষ্যতে এই ব্যাটারি দিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চয় কেন্দ্রও চালানো যাবে। এরইমধ্যে চীনের গুয়াংজি প্রদেশে একটি সোডিয়াম ব্যাটারির বিদ্যুৎ স্টোরেজ কেন্দ্র চালু হয়েছে, যা প্রতিদিন দেড় হাজারের মতো পরিবারকে বিদ্যুৎ দিতে পারছে। সস্তা ও কার্যকর লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির দৌঁড়ে চীনের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার চেষ্টা করছে বিশ্ব। তবে চীন ব্যাটারি খাতে আরেকটি বিকল্প প্রযুক্তিতে বিশ্বকে আরো এক ধাপ পেছনে ফেলছে। গণহারে সোডিয়াম আয়ন ব্যাটারি উৎপাদনের পথে অনেকটা এগিয়ে গেছে দেশটি। আর এবার তারা এই প্রযুক্তি জনপ্রিয় করতে ব্যবহার করছে স্কুটার।
চীনের পূর্বাঞ্চলের হাংঝৌ শহরের এক বিপণি বিতানের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে একঝাঁক ঝকঝকে ইলেকট্রিক মোপেড। দেখতে অনেকটা ভেসপার মতো। দাম ৩০০ থেকে ৫০০ পাউন্ডের মধ্যে (৪০০ থেকে ৬৬০ মার্কিন ডলার আর বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৫০ হাজার থেকে ৯০ হাজার)। তবে এগুলোর ব্যাটারি সাধারণ লিথিয়াম আয়ন বা লিড অ্যাসিড নয়। এগুলোতে ব্যবহৃত হচ্ছে সোডিয়াম—যা সমুদ্রের লবণ থেকেও সংগ্রহ করা যায়।
চীনের অন্যতম বৈদ্যুতিক টু-হুইলার নির্মাতা ইয়াদিয়া ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে এক প্রচারণা অনুষ্ঠানে প্রথম এই সোডিয়াম-চালিত মডেলগুলো প্রদর্শন করে। সেখানে ছিল দ্রুত চার্জিং পিলার, যা মাত্র ১৫ মিনিটে ৮০ শতাংশ চার্জ দিতে পারে। এছাড়া ছিল ব্যাটারি সোয়াপিং স্টেশন, যেখানে মাত্র একটি কিউআর কোড স্ক্যান করে পুরোনো ব্যাটারি দিয়ে নতুন চার্জকৃত ব্যাটারি নিয়ে নেয়া যায়। ইয়াদিয়া এরই মধ্যে তিনটি সোডিয়াম-চালিত স্কুটার বাজারে এনেছে। আরো কয়েকটি মডেল আনার পরিকল্পনা করছে। প্রতিষ্ঠানটি হাংঝৌতে ‘হুয়ায়ু নিউ এনার্জি রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ নামে একটি গবেষণা কেন্দ্রও চালু করেছে, যার লক্ষ্য নতুন ব্যাটারি প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা। চীনে দুই চাকার ইলেকট্রিক যানবাহন অতি জনপ্রিয়। ২০২৩ সালে দেশটিতে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি ইলেকট্রিক টু-হুইলার বিক্রি হয়েছে। যা একই বছরে বিক্রি হওয়া সব ধরনের ইলেকট্রিক কারের সংখ্যার ছয় গুণ। এই বিশাল বাজারের কারণেই ব্যাটারি নির্মাতারা সোডিয়াম আয়ন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগে আগ্রহী।
এই ধরনের যানবাহন সাধারণত কম গতিতে ও অল্প দূরত্বে চলে, তাই এখানে উচ্চ এনার্জি ডেনসিটি প্রয়োজন হয় না। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির তুলনায় সোডিয়াম আয়ন ব্যাটারির শক্তি ধারণ ক্ষমতা কম হলেও তা লিড-অ্যাসিড ব্যাটারির চেয়ে বেশি টেকসই। ফলে এটি একটি মধ্যম মূল্যমানের বিকল্প হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে।
২০২৪ সালে ইয়াদিয়া শেনঝেনে দেড় লাখ ফুড ডেলিভারি কর্মীর জন্য একটি পাইলট প্রকল্প চালু করে। এতে তারা সোডিয়াম আয়ন ব্যাটারি ব্যবহৃত স্কুটার ও ব্যাটারি সোয়াপিং সুবিধা দেয়। ব্যাটারি বদলাতে সময় লাগে মাত্র ৩০ সেকেন্ড। এই উদ্যোগ এতটাই সফল হয়েছে যে, শেনঝেন শহর ২০২৫ সালের মধ্যে ২০ হাজার আর ২০২৭ সালের মধ্যে ৫০ হাজার চার্জিং বা সোয়াপিং স্টেশন স্থাপনের লক্ষ্য নিয়েছে।
শুধু স্কুটারে নয়, ভবিষ্যতে এই ব্যাটারি দিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চয় কেন্দ্রও চালানো যাবে। এরইমধ্যে চীনের গুয়াংজি প্রদেশে একটি সোডিয়াম ব্যাটারির বিদ্যুৎ স্টোরেজ কেন্দ্র চালু হয়েছে, যা প্রতিদিন দেড় হাজারের মতো পরিবারকে বিদ্যুৎ দিতে পারছে।
পৃথিবীর ভূত্বকে ও সমুদ্রে সোডিয়ামের প্রাচুর্য লিথিয়ামের চেয়ে প্রায় ৪০০ গুণ বেশি। ফলে সোডিয়াম-আয়ন ব্যাটারি সস্তা ও সহজলভ্য কাঁচামালে তৈরি করা সম্ভব। তাছাড়া সোডিয়াম ব্যাটারিতে কোবাল্ট ও নিকেলের মতো পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ধাতু ব্যবহারের প্রয়োজন নেই।
তবে সোডিয়াম-আয়ন প্রযুক্তি একেবারে নতুন নয়। এর উন্নয়নের চেষ্টা শুরু হয়েছিল সেই ১৯৭০-এর দশকেই। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোনির প্রথম সফল লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি বাজারে আসার পর সোডিয়াম প্রযুক্তির উন্নয়ন থেমে যায়। ২০২১ সালে লিথিয়ামের মূল্য চরম আকারে বেড়ে যাওয়ার পর আবার সোডিয়াম আয়ন ব্যাটারির প্রতি আগ্রহ বাড়ে।
২০২৪ সালে চীনে বেশ কিছু লিথিয়াম-চালিত টু-হুইলারের আগুন লাগার ঘটনা মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। গবেষকরা বলছেন, সোডিয়াম আয়ন ব্যাটারির তাপপ্রবণতা কম ও ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় ভালো কাজ করে। উদাহরণ হিসেবে, চীনের শি’আন জিয়াওতং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এমন এক ধরনের সোডিয়াম ব্যাটারি ইলেকট্রোলাইট তৈরি করেছেন, যা -৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও ব্যাটারির ৮০ শতাংশ কার্যকারিতা বজায় রাখতে পারে।
২০২৪ সালে চীনের কোম্পানিগুলো ১৮০ গিগাওয়াট ঘণ্টা ক্ষমতার ২৭টি সোডিয়াম ব্যাটারি কারখানা গড়ার ঘোষণা দেয়। চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো এরইমধ্যে ৫৫ বিলিয়ন ইউয়ান (৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার) এই প্রযুক্তির গবেষণায় বিনিয়োগ করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের সব ব্যাটারি স্টার্টআপের সম্মিলিত তহবিলের চেয়েও বেশি।
বিবিসি অবলম্বনে
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন