হ্যারি পটার তাকে বিলিয়নিয়ার বানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বিপুল দানের কারণে এ ক্লাব থেকে বেরিয়ে যান তিনি। তবে পটারভার্সের বই, সিনেমা, নাটক ও থিম পার্কের সুবাদে আবার ফিরে এসেছেন এই বনেদি ক্লাবে।
ট্রান্সজেন্ডার-বিরোধী অবস্থানের কারণে নিজ দেশে হ্যারি পটারের স্রষ্টা জে কে রাউলিংকে নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠলেও সেটি তার আয়ে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। ২০২০ সালে এ ইস্যুতে প্রকাশ্যে লেখা শুরু করার পরের চার বছরে, ফোর্বসের হিসাব অনুযায়ী, ৫৯ বছর বয়সী এই লেখিকা প্রতি বছর গড়ে ৮০ মিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করেছেন। তার এই আয় এসেছে বই বিক্রি এবং তার সৃষ্ট ‘পটারভার্স’-এর শাখা চলচ্চিত্র, টিভি সিরিজ, থিম পার্ক, ভিডিও গেম, থিয়েটার ও মার্চেন্ডাইজ লাইসেন্স থেকে। মোটা অঙ্কের কর ও বিপুল পরিমাণ দান করার পরও এই ব্রিটিশ লেখক নির্বিঘ্নেই ফিরে এসেছেন বিলিয়নিয়ারের তালিকায়। ফোর্বসের হিসাব অনুযায়ী, এখন তিনি মোট ১.২ বিলিয়ন ডলার সম্পত্তির মালিক। ২০০৪ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত—পটারম্যানিয়া যখন তুঙ্গে—রাউলিং নিয়মিতই ফোর্বস বিলিয়নিয়ার তালিকায় উঠে আসেন। ২০১২ সালে মানবকল্যাণমূলক কাজে ১৬০ মিলিয়ন ডলার দানের তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর তিনি এই তালিকা থেকে বাদ পড়েন। কিন্তু গত কয়েক বছরে মিডিয়ার প্রতিটি শাখা থেকে আসা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আয়ের সুবাদে তিনি আবার ফিরে এসেছেন বিলিয়নিয়ার ক্লাবে। রাউলিংয়ের আয়ের এই গতিতে ভাটা পড়ার কোনো লক্ষণ নেই। এই গ্রীষ্মেই শুরু হচ্ছে এইচবিও ম্যাক্স-এর নতুন হ্যারি পটার সিরিজের শুটিং। এই নতুন টেলিভিশন অ্যাডাপ্টেশন ২০২৬ সালের শেষ নাগাদ সম্প্রচার শুরু হয়ে দশ বছর ধরে চলবে বলে আশা করা হচ্ছে। ফোর্বসের হিসাব অনুযায়ী, নতুন এই চুক্তি থেকে রাউলিং বছরে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার আয় করবেন, ওয়ার্নার ব্রাদার্সের সঙ্গে করা একটি বৃহৎ চুক্তির অংশ হিসেবে। এইচবিও ম্যাক্স-এর সিইও কেসি ব্লয়েস গত নভেম্বরে বলেন, লেখক ও পরিচালক বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় রাউলিং ‘খুবই, খুবই সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন’।
রাউলিংয়ের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে এপ্রিলে এক টিভি অনুষ্ঠানে প্রশ্ন করা হলে ব্লয়েস বলেন, ‘ওই মতামত তার অধিকার। আপনি তার সঙ্গে বিতর্ক করতে চাইলে টুইটারে যেতে পারেন।’ ১৯৯৭ সালে হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসফারস স্টোন প্রকাশের পর থেকে প্রায় তিন দশকে, জে কে রাউলিং অসাধারণ দূরদর্শিতায় ‘পটারভার্স’-কে ব্র্যান্ডে পরিণত করেছেন। এ ব্র্যান্ড সম্ভবত শার্লক হোমস ও জেমস বন্ডের মতোই বহু দশক রাজত্ব করবে। হাজার হাজার ভোক্তার উপর জরিপ চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে শক্তিশালী ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি (আইপি) ব্র্যান্ডগুলোর তালিকা তৈরি করে হ্যাবো স্টুডিও। তাদের হিসেবে, হ্যারি পটার বর্তমানে সমগ্র বিনোদন দুনিয়ায় ষষ্ঠ শক্তিশালী ব্র্যান্ড, আর মিলেনিয়ালদের মধ্যে এর অবস্থান প্রথম।
পটারভার্সের সম্ভাবনা আঁচ করতে পেরে প্রথম বই প্রকাশের আগেই চলচ্চিত্রের স্বত্ব কিনে নেয় ওয়ার্নার ব্রাদার্স। তখন রাউলিং ছিলেন সিঙ্গেল মাদার, ব্রিটেনের স্যোশাল ওয়েলফেয়ারের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। এক সাক্ষাৎকারে তিনি দ্য লন্ডন টাইমসকে বলেন, ‘আধুনিক ব্রিটেনে গৃহহীন না হয়েও যতটা গরিব হওয়া সম্ভব, আমি ঠিক ততটাই গরিব ছিলাম।’ ২০০১ সালের শেষদিকে যখন প্রথম সিনেমা মুক্তি পেল, ততদিনে রাউলিংয়ের চারটি বই প্রকাশিত হয়ে গেছে, বিক্রি ছাড়িয়েছে ১০০ মিলিয়ন কপি। এর মাত্র দুই বছর পর রাউলিংয়ের তৎকালীন এজেন্ট ক্রিস লিটল ফোর্বসকে বলেন, হ্যারি পটার সিরিজ তখন পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে ২৫০ মিলিয়ন কপির বেশি। এরপর ফিল্ম ফ্র্যাঞ্চাইজটি ইতিহাস গড়ে। ২০১১ সালে শেষ ছবিটি মুক্তির সময় পর বিশ্বব্যাপী হ্যারি পটার ফ্র্যাঞ্চাইজের বক্স অফিস আয় দাঁড়ায় প্রায় ৭.৭ বিলিয়ন ডলার—ওই সময় ইতিহাসের সর্বোচ্চ আয় করা ফিল্ম ফ্র্যাঞ্চাইজি।
এরপর ওয়ার্নার ব্রাদার্সের সঙ্গে রাউলিংয়ের চুক্তি একাধিকবার নবায়ন হয়। চুক্তিতে যুক্ত হয় নানা ধারা ও সুরক্ষা—মুনাফা ভাগাভাগির অধিকার, শেষ দুটি ছবিতে নির্বাহী প্রযোজকের ক্রেডিট এবং ‘নন-অথর রিটেন সিক্যুয়েল’-এর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। অর্থাৎ রাউলিংয়ের অনুমতি ছাড়া হ্যারি পটার নিয়ে আর কিছুই তৈরি করা যাবে না।
জে কে রাউলিং তার রাজনৈতিক মতাদর্শের চেয়েও নিজের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর অধিকার রক্ষায় বেশি কঠোর ছিলেন।
এই চুক্তির বিশেষ ধারার ফলেই তিনি ২০১৬ সালে হ্যারি পটারের স্পিন-অফ ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস অ্যান্ড হোয়্যার টু ফাইন্ড দেম ও এ দুটি সিক্যুয়েলের চিত্রনাট্য নিজে লেখার অধিকার পান। তবে রাউলিংয়ের ট্রান্সজেন্ডার-বিরোধী অবস্থানের কারণে তার বিরুদ্ধে বয়কটের ডাক ওঠার পরপরই ২০২২ সালে মুক্তি পায় তৃতীয় কিস্তি ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস: দ্য সিক্রেটস অভ ডাম্বলডোর। এর জেরে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলারের বাজেটে তৈরি এই ছবি বিশ্বব্যাপী আয় করে মাত্র ৪০০ মিলিয়ন ডলার।
‘ক্যানসেল কালচারের’ এই ডামাডোলেও রাউলিং ‘ক্যানসেল’ হননি। এই সময়েই হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য কার্সড চাইল্ড মঞ্চনাটকের টিকিট ধারাবাহিকভাবে বিক্রি হতে থাকে দেশে-বিদেশে। ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত এই নাটক মোট আয় করেছে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি—যার মুনাফার ভাগ পেয়েছেন রাউলিং। রবার্ট গলব্রেইথ চদ্মনামে লেখা রাউলিংয়ের প্রাপ্তবয়স্ক গোয়েন্দা উপন্যাস অবলম্বনে সি.বি. স্ট্রাইক সিরিজের পঞ্চম সিজনও তৈরি করেছে এইচবিও ম্যাক্স। আর ২০২৩ সালে মুক্তি পায় ভিডিও গেম হোগওয়ার্টস লিগ্যাসি, যার ২৪ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়। ওই বছরে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া গেম এটি। আয় এনেছে ১ বিলিয়ন ডলার।
বিক্রির এই গতি দেখে ওয়ার্নার ব্রাদার্স পটার প্রকল্পে আরও বেশি বিনিয়োগে উৎসাহী হয়ে ওঠে। তাই ২০২২ সালে কোম্পানির নতুন সিইও ডেভিড জাসলাভ দায়িত্ব নেবার পর নিজে স্কটল্যান্ড উড়ে যান রাউলিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে। উদ্দেশ্য, জাদুর জগতের নতুন কনটেন্ট তৈরি করার পথ খোঁজা। রাউলিংয়ের হাতে ছিল প্রিকুয়েল আর স্পিন-অফের স্বত্ব, কিন্তু মূল সাতটি উপন্যাসের বিভিন্ন উপাদানের স্বত্ব তখনও ওয়ার্নার ব্রাদার্সের দখলে। এ কারণেই তারা মূল সিরিজ রিমেকের পরিকল্পনা নিয়ে এগোয়। শেষপর্যন্ত ২০২৩ সালে রাউলিংয়ের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন মেলে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, পটারভার্সের সর্বব্যাপী উপস্থিতি সত্ত্বেও এই জগতের ওপর রাউলিংয়ের লৌহকঠিন নিয়ন্ত্রণ এবং প্রায় একক স্বত্ব একে অতিরিক্ত ব্যবহার ও সৃজনশীল ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছে।
হ্যারি পটার ব্র্যান্ড যেখানেই যায়, সেখানে তৈরি হয় উন্মাদনা। ২০১০ সালে ইউনিভার্সাল থিম পার্ক আইল্যান্ডস অভ অ্যাডভেঞ্চার-এ যখন প্রথম উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ড চালু হয়, তখন পার্কে দর্শনার্থীর সংখ্যা এক লাফে ৩৬ শতাংশ বেড়ে যায়। আয় বাড়ে ৪০ শতাংশ। এরপর থেকে অরল্যান্ডো, হলিউড, টোকিও ও বেইজিংয়ে বিভিন্ন পার্কের একাংশে স্থান পায় হ্যারি পটার। সবগুলো পার্কেই দর্শনার্থী বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। এছাড়া ওয়ার্নার ব্রাদার্সের স্টুডিও ট্যুর মেকিং অভ হ্যারি পটার ২০২৩ সালে আয় করেছে ৩০০ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ১২০ মিলিয়ন ডলার ছিল নিট মুনাফা।
‘ডিজনি থেকে সিক্স ফ্ল্যাগ—কোনো পার্কেই ৩৬ শতাংশ দর্শক বৃদ্ধির এমন ঘটনা আর ঘটেনি,’ বলেন ইন্টারন্যাশনাল থিম পার্ক সার্ভিসেস-এর প্রতিষ্ঠাতা ডেনিস স্পিগেল। ‘আমার মতে, থিম পার্ক ইতিহাসে হ্যারি পটার লাইসেন্স চুক্তিটিই গত ৪০ বছরের সবচেয়ে লাভজনক চুক্তি।’
ইউনিভার্সাল মূলত ওয়ার্নার ব্রাদার্স থেকে লাইসেন্স নেয়। ফলে প্রতিটি বিক্রির একটা অংশ যায় রাউলিংয়ের পকেটে। ফোর্বসের হিসাব অনুযায়ী, গত এক দশকে থিম পার্কই ছিল রাউলিংয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম আয়ের উৎস। তবে রাউলিংয়ের সাম্রাজ্যের হৃৎপিণ্ড আজও তার বই বিক্রিই। হ্যারি পটারের মার্কিন প্রকাশক স্কলাস্টিক জানায়, সিরিজটির মোট বিক্রি ৬০০ মিলিয়ন কপি ছাড়িয়েছে। ৮৪৩ সপ্তাহ ধরে এটি নিউইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার তালিকায় আছে। কার্সড চাইল্ড-এর হার্ডকভার সংস্করণ—যা রাউলিং, থর্ন ও পিরিচালক জন টিফানির কাহিনির ওপর ভিত্তি করে নাট্যকার জ্যাক থর্ন লিখেছেন—প্রথম বছরেই বিক্রি হয় ৪ মিলিয়ন কপির বেশি। এছাড়া ২০২৪ সালে প্রকাশিত পিকচার বুক ক্রিসমাস অ্যাট হোগওয়ার্টস বছরের সেরা হলিডে বই হয়। রবার্ট গলব্রেইথ ছদ্মনামে ২০১৩ সাল থেকে পাঁচটি গোয়েন্দা উপন্যাসও লিখেছেন রাউলিং।
রাউলিং কখনোই তার সাহিত্যকর্মের ই-বুক স্বত্ব বিক্রি করেননি। বরং ২০১২ সালে নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রকাশনা সংস্থা পটারমোর পাবলিশিং। মহামারিকালে এ ব্যবসায় সুবাতাস লাগে। এখন এই প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রতি বছর তার কয়েক মিলিয়ন ডলার আয় হয়। রাউলিংয়ের ম্যানেজমেন্ট টিম দ্য ব্লেয়ার পার্টনারশিপের একজন মুখপাত্র তার সম্পদের বিষয়ে ফোর্বসকে সরাসরি মন্তব্য করতে রাজি হননি। রাউলিংয়ের আয় ও আয়ের বহুমুখী উৎস বিবেচনায় নিলে তার নিট সম্পত্তি আরও অনেক বেশি হওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু তিনি দাতব্য কাজের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ।
ফোর্বশের প্রাক্কলন অনুসারে, গত ২০ বছরে তিনি ২৫০ মিলিয়ন ডলারের বেশি দান করেছেন। এই দানের বেশিরভাগ গেছে তিনটি প্রতিষ্ঠানে। প্রথম প্রতিষ্ঠান: লুমোস। সংস্থাটি এতিমখানার অনাথ শিশুদের সাহায্য করে। এখন পর্যন্ত রোমানিয়া, হাইতি, কলম্বিয়া ও ইউক্রেনে ২ লাখ ৮০ হাজারের বেশি শিশু উপকৃত হয়েছে এ প্রতিষ্ঠান থেকে। দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান: ভোল্যান্ট। যৌন নির্যাতন ও গার্হস্থ্য সহিংসতার শিকার ও ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের সহায়তা করে তারা। তৃতীয় প্রতিষ্ঠান: অ্যান রাউলিং রিজেনারেটিভ। নিউরোলজিক্যাল রোগীদের চিকিৎসায় সহায়তা করে এ সংস্থা—বিশেষ করে এমএস রোগীদের, যে রোগে রাউলিংয়ের মায়ের মৃত্যু হয়েছিল।
রাউলিং বহুবার বলেছেন, স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় নিজের বসবাস এবং স্কটল্যান্ডের সর্বোচ্চ আয়কর হারে (৪৫ শতাংশ) কর দেওয়া নিয়ে তিনি গর্বিত। ২০১০ সালে রাউলিং লিখেছিলেন: তিনি চান, তার সন্তানরা হোক ‘প্রকৃত দেশের নাগরিক, কর ফাঁকি দেওয়া কোনো প্রবাসী নয়’। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের সম্পদ নিয়ে কেথা বলতে রাউলিং একটুও সংকোচ বোধ করেন না। বরং মাঝে মাঝে সেটিকেই অস্ত্র করে তোলেন তার ট্রান্সবিরোধী অবস্থান নিয়ে সমালোচনা করতে আসা মানুষদের মোকাবিলায়। ২০২২ সালে এক্স-এ এক ব্যবহারকারী লিখেছিলেন: ‘আপনার বই আর পাঠকদের বিরাট একটা অংশ কিনছে না জেনেও রাতে ঘুমান কী করে?’
রাউলিংয়ের উত্তরে ছিল: ‘আমার সাম্প্রতিক রয়্যালটি চেকগুলো পড়ি, তাতেই সমস্ত ব্যথা নিমেষে উবে যায়।’
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন