মধ্যপ্রাচ্যকে ট্রাম্পের অঙ্গীকার: ‘কীভাবে জীবনযাপন’ করবে এ নিয়ে আর লেকচার না – The Finance BD
 ঢাকা     মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ০৫:০৩ অপরাহ্ন

মধ্যপ্রাচ্যকে ট্রাম্পের অঙ্গীকার: ‘কীভাবে জীবনযাপন’ করবে এ নিয়ে আর লেকচার না

  • ১৭/০৫/২০২৫

মঙ্গলবার (১৩ মে) সৌদি রাজধানী রিয়াদে এক বিনিয়োগ সম্মেলনে দেওয়া বিস্তৃত ভাষণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত তথাকথিত রাষ্ট্র নির্মাতারা যতটা না দেশ গড়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি দেশ ধ্বংস করেছে। আর যারা হস্তক্ষেপ করেছেন, তারা এমন জটিল সমাজে হস্তক্ষেপ করেছেন, যেগুলো তারা মোটেও বুঝতেন না।’
সৌদি আরবের এক জমকালো বলরুমে দাঁড়িয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ঘোষণা দেন, যুক্তরাষ্ট্র আর কোনো দেশের রাষ্ট্রগঠনে নাক গলাবে না বা হস্তক্ষেপ করবে না; এবং বিশ্বের পরাশক্তি আর কাউকে ‘কীভাবে জীবনযাপন করবে তা নিয়ে লেকচার দেবে না’– তখন উপস্থিত শ্রোতারা করতালিতে ফেটে পড়েন। এই ভাষণের মাধ্যমে ট্রাম্প কার্যত মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার দশকব্যাপী নীতিকে প্রত্যাখ্যান করেন। এটি এমন এক বার্তা, যা নিয়ে মরক্কো থেকে ওমান পর্যন্ত ক্যাফে কিংবা বৈঠকখানায় বহু দিন ধরেই আলাপ হয়ে আসছিল। মঙ্গলবার (১৩ মে) সৌদি রাজধানী রিয়াদে এক বিনিয়োগ সম্মেলনে দেওয়া বিস্তৃত ভাষণে ট্রাম্প বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত তথাকথিত রাষ্ট্র নির্মাতারা যতটা না দেশ গড়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি দেশ ধ্বংস করেছে। আর যারা হস্তক্ষেপ করেছেন, তারা এমন জটিল সমাজে হস্তক্ষেপ করেছেন, যেগুলো তারা মোটেও বুঝতেন না।’
তিনি মধ্যপ্রাচ্যের জনগণকে আহ্বান জানান ‘নিজেদের ভাগ্য নিজেদের মতো করে নির্ধারণ’ করার। ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসন এবং সাম্প্রতিক সময়ে গাজায় যুদ্ধ তীব্রতর করার ক্ষেত্রে ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন, যার ফলে অঞ্চলটি এখন দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে—এসব বিষয় মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের চেতনাতেই গেঁথে আছে। তাই ট্রাম্পের বক্তব্য মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে মোবাইল ফোনের পর্দায়। সমালোচনা আসে রাজতন্ত্রের সমর্থক থেকে শুরু করে ভিন্নমতাবলম্বীদের কাছ থেকেও। সৌদি শিক্ষাবিদ সুলতান আলআমের রসিকতা করে বলেন, ট্রাম্পের বক্তব্য যেন বিংশ শতাব্দীর মার্কসবাদী চিন্তাবিদ ফ্রাঞ্জ ফাঁনোর লেখার মতো শোনায়। ফাঁনো ঔপনিবেশিক নিপীড়নের গতিবিধি নিয়ে লিখেছিলেন। যখন ট্রাম্প ঘোষণা দেন, তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়ার ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবেন যাতে দেশটি ‘মহত্ত্বের পথে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়’; সিরিয়ানরা তখন মিম শেয়ার করে উল্লাস প্রকাশ করেন। আর ইয়েমেন–যেখানে যুদ্ধের পাশাপাশি মার্কিন নিষেধাজ্ঞাও চলছে, সেখানে আবদুল লতিফ মোহাম্মদ ট্রাম্পের ‘স্বাধীনতার ধারণা’র সঙ্গে পরোক্ষভাবে সহমত জানান, যদিও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে বিরক্তি প্রকাশ করেন। ‘কবে আমাদের স্বীকৃতি দেবে দেশগুলো? কবে আমরা বাকিদের মতো স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারব?’—রাজধানী সানার এক রেস্তোরাঁ ব্যবস্থাপক, ৩১ বছর বয়সী মোহাম্মদ ট্রাম্পের বক্তৃতা প্রসঙ্গে এমন প্রশ্ন তোলেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জোসেফ আর. বাইডেন জুনিয়র ও ট্রাম্প—উভয়ের সময়েই মার্কিন বিমান হামলায় তার শহর কেঁপে উঠেছে। লক্ষ্য ছিল ইরান-সমর্থিত হুথি গোষ্ঠী। চলতি মাসেই ট্রাম্প হঠাৎ করেই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন।
মোহাম্মদ বলেন, ‘ট্রাম্প কে? তিনি কাকে ক্ষমা করবেন, কোন দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবেন বা তা তুলে নেবেন—এসব ঠিক করার তিনি কে?’ এরপর নিজেই বলেন, ‘তবে দুনিয়াটা এভাবেই চলে।’
চার দিনের এক সফরের শুরুতে এই মন্তব্য করেন ট্রাম্প। সফরে তিনি ঘুরে দেখেন উপসাগরীয় অঞ্চলের তিন ধনী আরব দেশ—সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। সফরের বড় অংশজুড়ে ছিল ব্যবসায়িক চুক্তির আলোচনা। তিন দেশ সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে রিয়াদে দেওয়া তার বক্তব্যে পরিষ্কার বোঝা গেছে—এ সফরের কূটনৈতিক লক্ষ্য ছিল আরও বিস্তৃত। তিনি সৌদি আরবকে আহ্বান জানান যেন প্রতিবেশী সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের পথ অনুসরণ করে এবং ইসরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়। (তবে সৌদি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরই কেবল এ ধরনের স্বীকৃতি বিবেচনা করা হবে।)
তিনি বলেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে তিনি অত্যন্ত আগ্রহী। এও বলেন, ‘চিরস্থায়ী শত্রুতে’ তার বিশ্বাস নেই। বুধবার তিনি সাক্ষাৎ করেন সিরিয়ার নতুন নেতা আহমেদ আল-শারার সঙ্গে—এক সময়ের জিহাদপন্থি, যিনি একটি বিদ্রোহী জোটের নেতৃত্ব দিয়ে নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই সময় আল-শারা ও সৌদি যুবরাজের সঙ্গে একটি ছবিও তোলেন, যা শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই নয়, বিশ্বব্যাপী বিস্ময় জাগিয়েছে।
‘বন্ধু, যা ঘটেছে, তা সত্যিই অবিশ্বাস্য,’ বললেন ইয়েমেনি রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ। সৌদি জনগণের সামনে ট্রাম্পের সৌহার্দ্যপূর্ণ ভঙ্গিমা স্পষ্টভাবে ভিন্ন ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মন্থর এবং সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গির তুলনায়। বাইডেনের এ মনোভাব ছিল সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রতি, যিনি সৌদি আরবের বাস্তবিক শাসক এবং দীর্ঘদিন ধরে ইয়েমেনে বিমান হামলা চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর দমন-পীড়ন করেছেন এবং সামাজিক নিষেধাজ্ঞা অনেকটাই শিথিল করেছেন।
অন্যদিকে ট্রাম্প যুবরাজ মোহাম্মদ ও পুরো আরব উপদ্বীপের প্রতি প্রশংসার বন্যা বইয়ে দেন। তিনি যুবরাজকে আখ্যা দেন ‘অসাধারণ একজন মানুষ’ হিসেবে। ট্রাম্প বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক বেশি মার্কিন প্রেসিডেন্ট এক ধরনের ভ্রান্ত ধারণায় আক্রান্ত হয়েছেন—তারা ভাবেন, বিদেশি নেতাদের আত্মার গভীরে তাকানো এবং তাদের পাপের বিচার করা নাকি যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হওয়া উচিত।’ মার্কিন চাপ শিথিল হয়ে পড়লে আরব দেশগুলোর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি কীভাবে প্রভাবিত হতে পারে, এই আশঙ্কা অনেক আরব শ্রোতার মনে দাগ কেটেছে। ইব্রাহিম আলমাদি একজন ৭৫ বছর বয়সী মার্কিন-সৌদি দ্বৈত নাগরিকের ছেলে, যিনি সৌদি আরবে সমালোচনামূলক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্টের কারণে গ্রেপ্তার হন। পরে তাকে মুক্তি দেওয়া হলেও সৌদি আরব ত্যাগ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
এক সাক্ষাৎকারে আলমাদি বলেন, ট্রাম্পের সৌদি সফরে তিনি আশা করেছিলেন, তার বাবার বিষয়টি নিয়ে সৌদি কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন। এ নিয়ে তিনি ট্রাম্প প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কোনো সাড়া পাননি। তিনি মনে করেন, এটি এমন একটি মানবাধিকার লঙ্ঘন, যেটি নিয়ে আগের মার্কিন প্রশাসনগুলো সৌদি সরকারের সঙ্গে জোরালোভাবে কথা বলত।
‘তারা আমার বাবার ঘটনাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিচ্ছেন, অথচ এটা মোটেও স্বাভাবিক নয়,’ বলেন আলমাদি, ট্রাম্প প্রশাসনের প্রসঙ্গে। হোয়াইট হাউজের একজন মুখপাত্রের কাছে জানতে চাওয়া হলেও প্রেসিডেন্ট বা তার উপদেষ্টারা সৌদি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মানবাধিকার নিয়ে কোনো আলোচনা করেছেন কি না—সে বিষয়ে কোনো উত্তর দেননি। বক্তব্য নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে মুখপাত্র আনা কেলি বলেন, ‘প্রেসিডেন্টের ভাষণ সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছে।’ সৌদি আরবে নির্বাসিত একটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং কারাবন্দি একজন খ্যাতনামা আলেমের ছেলে আবদুল্লাহ আলাওধ ভাষণটিকে প্রিন্স মোহাম্মদের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে একটি ‘জনসংযোগ কৌশল’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প যখন বলছিলেন, “মধ্যপ্রাচ্য গড়েছে এখানকার মানুষই”, তখন চারপাশে বিদেশি ধনকুবেরদের ভিড় এবং সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন এমন একজন স্বৈরশাসক, যিনি ভিন্নমতকে নির্মমভাবে দমন করেছেন—এই প্রেক্ষাপটে তার বক্তব্যকে আমি রীতিমতো বিদ্রুপ মনে করেছি।’
রিয়াদের একটি বলরুমে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভাষণ শেষে শ্রোতারা উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দেন। ‘প্রেসিডেন্টের ভাষণটি বাস্তবিকই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল,’ বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান। তিনি এটিকে ‘অংশীদারত্ব ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের এক দৃষ্টিভঙ্গি’ বলে উল্লেখ করেন।
ওয়াশিংটনের গবেষণা সংস্থা নিউ লাইনস ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো আলআমের এক সাক্ষাৎকারে বলেন, প্রেসিডেন্টের বক্তব্যে এমন কিছু বিষয় উঠে এসেছে, যা সাধারণত বামপন্থী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে যুক্ত থাকে।
‘আমরা, আরবরা, এতদিন আমেরিকার উপদেশ ও হস্তক্ষেপের শিকার হয়ে এসেছি—এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এটি বিস্ময়কর। তবে নতুন ডানপন্থি জনতাবাদী আন্দোলনগুলো—উপসাগরীয় অঞ্চল ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় জায়গাতেই—বামপন্থিদের কিছু বক্তব্য ধার করে তা রূপান্তরিত করে রক্ষণশীল আদর্শ প্রতিষ্ঠায় ব্যবহার করছে—এই প্রেক্ষাপটে দেখলে এটি আর তেমন বিস্ময়ের নয়,’ বলেন আলআমের। প্রখ্যাত মিশরীয় মানবাধিকার আইনজীবী নেগাদ আল-বোরাই বলেন, ট্রাম্পের ভাষণের বিষয়বস্তু নিয়ে তিনি খুব বেশি গুরুত্ব দিতে চান না, কারণ প্রেসিডেন্ট সৌদি আরবে এসেছেন মূলত বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা করতে। তবে তার মতে, ট্রাম্প কেবল খোলামেলা ভাষায় বলছেন—যা অতীতে অন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টরাও মনে মনে বিশ্বাস করতেন—যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই নিজের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে, তা তারা যতই মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের কথা বলুক না কেন। ‘যুক্তরাষ্ট্র নিজের স্বার্থকে সবার আগে রাখে,’ বলেন তিনি। ‘ট্রাম্প শুধু তার মতামত স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেন, আর সেটাই তার সব ভাষণে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে।’

ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

Leave a Reply




Contact Us