সৌদি আরব, ওপেক প্লাসের অঘোষিত নেতা, স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, তারা আর একা তেলের উৎপাদন সীমিত রাখতে রাজি নয়, বিশেষ করে যখন কাজাখস্তান ও ইরাকের মতো সদস্যরা নির্ধারিত উৎপাদন সীমা মানছে না।
বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের বাজারে চলছে মূল্যের পতন, অর্থনীতিবিদরাও হ্রাস করছেন বৈশ্বিক অর্থনীতির পূর্বাভাস, সবমিলিয়ে মুনাফাও কমছে আন্তর্জাতিক জ্বালানি কোম্পানিগুলোর। এতকিছুর পরেও ওপেক প্লাস জোটভুক্ত আটটি দেশ— আগামী জুন থেকে দৈনিক ৪ লাখ ১১ হাজার ব্যারেল তেল উত্তোলন বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। আজ শনিবার (৩ মে) এক বিবৃতিতে এই সিদ্ধান্ত জানায় ওপেক প্লাস, যারা গত এপ্রিল মাসেও তেল উৎপাদন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এটি জোটটির নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা বিশ্বব্যাপী জ্বালানি শিল্পে প্রভাব ফেলবে এবং অনেক তেল কোম্পানির মুনাফা হ্রাসের পাশাপাশি— উৎপাদন খাতে কাটছাঁটের শঙ্কা তৈরি করবে। যদিও ওপেক প্লাস বলছে, বাজার এখনও ‘চাঙ্গা’ রয়েছে এবং (অনেক দেশের হাতে) তেলের মজুদও কম।
সৌদি আরব, ওপেক প্লাসের অঘোষিত নেতা, স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, তারা আর একা তেলের উৎপাদন সীমিত রাখতে রাজি নয়, বিশেষ করে যখন কাজাখস্তান ও ইরাকের মতো সদস্যরা নির্ধারিত উৎপাদন সীমা মানছে না। “সৌদি আরবের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, তারা আর অন্যদের ব্যর্থতা সামাল দিতে চায় না,” বলছেন লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনার্জি অ্যাসপেক্টস-এর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রিচার্ড ব্রোঞ্জ। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (আইইএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে তেলের ব্যবহার বা চাহিদা দৈনিক ১২ লাখ ব্যারেল বেড়েছিল, যা ২০২৩ সালের পর সর্বোচ্চ। তবে বিশ্ববাণিজ্যে অস্থিরতা এবং টানাপোড়েনের কারণে অনেক বিশ্লেষক এখন চাহিদার পূর্বাভাস কমিয়ে দিচ্ছেন। এপ্রিলের ৩ তারিখ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বাজারে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ২০ শতাংশের মতো কমে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডব্লিউটিআই (ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট) সূচকে তেলের দাম ৬০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে, যা অনেক উৎপাদনকারীর জন্য লোকসানের সীমা। এর ফলে মার্কিন শেল উৎপাদকদেরও উৎপাদন কমানোর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। “যদি ওপেক প্লাস দাম ধরে রাখতে তেল সরবরাহ কমাতে ব্যর্থ হয়, তবে উচ্চ ব্যয়ের উৎপাদনকারীদের কাঁধেই চাপ পড়বে,” বলেছে এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল কমোডিটি ইনসাইটস। বিশ্লেষকদের ধারণা, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিতে কিছু ছাড় পাওয়ার আশায় এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তারা ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ হতে চাইছে, বিশেষ করে ট্রাম্প যখন আসন্ন মধ্যপ্রাচ্য সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, এমন ধারা অব্যাহত থাকলে— জ্বালানি তেলের বাজারদর আরও কমতে পারে। এতে অনেক দেশেরই আমদানি ব্যয় কমবে। বিশেষত, বৈদেশিক মুদ্রা সংকটে থাকা দেশগুলোর জন্য সহজ হবে তেলের আমদানি। আরবিসি ক্যাপিটাল মার্কেটস-এর বৈশ্বিক জ্বালানি বিশ্লেষক হেলিমা ক্রফট লিখেছেন, তেলের দাম হ্রাস ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ইতিবাচক দিকগুলোর একটি,” কারণ তিনি গ্যাসসহ জ্বালানি খাতে ব্যয় কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একসময় ওপেক প্লাস সরবরাহ কমিয়ে বাজার সামলাতে তৎপর হতো, এখন তারাই উল্টো পথে হাঁটছে। আগের যে চুক্তি অনুযায়ী তারা প্রতিদিন ২২ লাখ ব্যারেল উৎপাদন কমিয়ে রেখেছিল, এখন সেই বাধা তুলে দিচ্ছে সৌদি আরব, রাশিয়া, আমিরাতসহ আটটি দেশ।
এই আট দেশের মধ্যেই এখন সব সিদ্ধান্ত হচ্ছে, বাকি সদস্যরা কেবল পেছনের সারির দর্শকের ভূমিকায় থাকছে। উৎপাদন বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সুবিধা নিচ্ছে সৌদি আরব। অর্থাৎ, বাজার দখলে এগিয়ে থাকছে। এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল-এর পরিচালক ভূষণ বাহরি বলেন, “এখন প্রশ্ন হলো—সৌদি আরব ও আমিরাত কি বাজারদর ধরে রাখতে আরও উৎপাদন কমাতে প্রস্তুত? উত্তর হচ্ছে আপাতত না।” অন্যদিকে কাজাখস্তান, ইরাক ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের কারণে উৎপাদন বাড়াতে আগ্রহী। মার্চ মাসে কাজাখস্তান ওপেক প্লাসের নির্ধারিত সীমার চেয়ে ৪ লাখ ব্যারেল বেশি উত্তোলন করেছে, ইরাক ৪ লাখ ৪০ হাজার ও আমিরাত ৩ লাখ ৫০ হাজার ব্যারেল বেশি উত্তোলন করেছে। কাজাখস্তানের তেনগিজ তেলক্ষেত্রে শেভরন ও এক্সন মোবিলের মতো আন্তর্জাতিক কোম্পানির বিশাল বিনিয়োগ আছে। সেই উৎপাদন সীমিত করতে রাজি নয় দেশটি। শেভরনের চেয়ারম্যান মাইক ওয়ার্থ বলেছেন, “আমরা ওপেক বা ওপেক প্লাস সংক্রান্ত আলোচনায় অংশ নেই না।” কাজাখস্তানের জ্বালানি মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা “জাতীয় স্বার্থ মেনে আন্তর্জাতিক চুক্তি পালন করে।”
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন