বুধবার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা উভয় দেশের যৌথ বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করবে— ইউক্রেনের খনিজ তেল, গ্যাস এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ খাতে। তবে বাস্তবে ইউক্রেনের ভূমির নিচে আসলে কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, তা এখনো অস্পষ্ট।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, ইউক্রেনের মাটির নিচে থাকা খনিজ সম্পদের মূল্য এক লাখ কোটি ডলার পর্যন্ত হতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রের বিরল খনিজের সরবরাহকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করবে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি-ও এসব খনিজকে “অমূল্য” বলে উল্লেখ করেছেন। বুধবার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা উভয় দেশের যৌথ বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করবে— ইউক্রেনের খনিজ তেল, গ্যাস এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ খাতে। তবে বাস্তবে ইউক্রেনের ভূমির নিচে আসলে কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, তা এখনো অস্পষ্ট। বিশ্লেষকরা বলছেন, খনিজ উত্তোলন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল, যার জন্য প্রয়োজন বিশাল অবকাঠামো। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরনের প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে টেকসই নয়। বর্তমানে যুদ্ধের ঝুঁকি এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা গ্যারান্টির ঘাটতির কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা-ও ইউক্রেনের খনিজ খাতে ব্যাপকভাবে জড়িত হতে চাইছেন না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট জানান, “যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন পুনর্গঠন বিনিয়োগ তহবিল” গঠন করা হয়েছে, যা দুই দেশকে যৌথভাবে বিনিয়োগের সুযোগ দেবে এবং ইউক্রেনের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার তরান্বিত করবে। আকাশছোঁয়া সম্ভাবনা, অনিশ্চিত বাস্তবতা
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যেসব খনিজের ব্যাপক চাহিদা যেমন লিথিয়াম, গ্রাফাইট, ইউরেনিয়াম ও টাইটেনিয়াম উত্তোলন করতে প্রয়োজন শত শত কোটি ডলারের বিনিয়োগ, বলেছেন রবার্ট মুগা, ভূরাজনৈতিক ও ডিজিটাল ঝুঁকি বিশ্লেষক ফার্ম সেকডেভ-এর প্রধান। তাঁর প্রতিষ্ঠান ইউক্রেনের সম্পদ নিয়ে ব্যাপক অধ্যয়ন করেছে। খনিজ চুক্তি নিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প ও জেলেনস্কির মধ্যে প্রাথমিক আলোচনার আগে একথা বলেন তিনি। ফেব্রুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প ও জেলেনস্কির মধ্যে বৈঠক চলাকালে এ বিষয়ে আলোচনার সময় বিতর্ক এতটাই তীব্র হয় যে, একপর্যায়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের উপস্থিতিতে তা বাকবিতণ্ডায় রূপ নেয়। ইউক্রেনের অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রী ইউলিয়া স্ভিরিদেঙ্কো বলেন, “চুক্তির সর্বশেষ সংস্করণটি— যুক্তরাষ্ট্রের ইউক্রেনের নিরাপত্তা ও পুনর্গঠনের প্রতি প্রতিশ্রুতিকে প্রতিফলিত করেছে।”
পুরনো জরিপ, অজানা সঞ্চয়
সোভিয়েত আমলে ইউক্রেনের খনিজ মানচিত্র তৈরি হলেও তা আজকের প্রেক্ষাপটে অচল বলে মনে করছেন দেশটির ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক রোমান ওপিমাখ। কারণ, অনেক গুরুত্বপূর্ণ খনিজের তথ্য এখনো গোপন রাখা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এক দশকের বেশি আগে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানকে এক ট্রিলিয়ন ডলারের খনিজ সম্ভারের দেশ হিসেবে আখ্যা দিলেও আজ পর্যন্ত সেই সম্পদ অপরিবর্তিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি একই রকম হতে পারে। সেকডেভ-এর হিসাব অনুযায়ী, ইউক্রেনের ৪০ শতাংশ গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রাশিয়ার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় অবস্থিত, যার মধ্যে রয়েছে খনিজসমৃদ্ধ ডনবাস অঞ্চল।
যেসব খনিজ আছে, সেগুলো কতটা কার্যকর?
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেন উল্লেখযোগ্য ‘রেয়ার আর্থ’ বা বিরল খনিজ সম্পদের অধিকারী নয়। তবে দেশটি লিথিয়াম, গ্রাফাইট, ইউরেনিয়াম এবং টাইটেনিয়ামের বড় মজুদ রয়েছে, যেগুলোকে “গুরুত্বপূর্ণ খনিজ” হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। লিথিয়াম ও গ্রাফাইট ব্যাটারির জন্য অত্যাবশ্যক, ইউরেনিয়াম পারমাণবিক শক্তির জন্য ব্যবহৃত হয়, আর টাইটেনিয়াম বাণিজ্যিক বিমান ও প্রতিরক্ষা শিল্পে ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ ধাতু। ইউক্রেন দাবি করেছে, বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ টাইটেনিয়ামের মজুদ তাদের মাটির নিচে রয়েছে, যদিও অনেক স্বাধীন গবেষণায় এর পরিমাণকে অনেক কম বলা হয়েছে। তবে টাইটেনিয়াম উৎপাদনের প্রথম ধাপ ‘টাইটেনিয়াম স্পঞ্জ’ তৈরি করতে প্রয়োজন জটিল ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। ইউক্রেনের একমাত্র উৎপাদন কেন্দ্র ‘জাপোরিঝিয়া টাইটেনিয়াম-ম্যাগনেশিয়াম’ বর্তমানে যুদ্ধের কারণে বন্ধ রয়েছে।
চীন ও রাশিয়া শীর্ষে, পশ্চিমা দুনিয়া পিছিয়ে
রাশিয়া ও চীন বর্তমানে বিশ্ব টাইটেনিয়াম বাজারে আধিপত্য বিস্তার করেছে। পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য এটি একটি বড় সরবরাহ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেনের কোম্পানি ভেলটা একটি দ্রুত ও ব্যয়সাশ্রয়ী টাইটেনিয়াম উৎপাদন প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছে, কিন্তু তা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার উপযোগী হতে কয়েক বছর সময় লাগবে।
অপর্যাপ্ত উত্তোলন, পুরনো প্রযুক্তি
ইউক্রেনের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে গ্রাফাইট খনিগুলো এখনো সোভিয়েত যুগের পুরনো প্রযুক্তিতে চলছে। ব্যাটারি-গ্রেড গ্রাফাইট উৎপাদনে পরিবেশ ও খরচজনিত সমস্যা রয়েছে। লিথিয়াম মজুদ থাকা সত্ত্বেও উত্তোলন হয় না, কারণ এগুলোর বেশিরভাগ পেটালাইট থেকে আসে, যেটি প্রক্রিয়াজাত করা অনেক বেশি ব্যয়বহুল। ইউরেনিয়াম উত্তোলনকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান ভোস্টগোক এতটাই অলাভজনক যে তা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।
তেল, গ্যাস ও ইস্পাত: সম্ভাব্য বিকল্প
ইউক্রেনের প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে লৌহ আকরের বিশাল মজুদ রয়েছে, যা তাদের ইস্পাত শিল্পের ভিত্তি। তবে পুরনো সোভিয়েত প্রযুক্তির কারণে ‘সবুজ ইস্পাত’ প্রযুক্তিতে রূপান্তরের পরিকল্পনাও ব্যাহত হচ্ছে। তেল ও গ্যাসের মতো খাতে তুলনামূলকভাবে দ্রুত বিনিয়োগ ফল দিতে পারে, তবে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ প্রকল্পগুলো থেকে বাস্তব ফল পেতে কয়েক দশক সময় লেগে যেতে পারে। ইউক্রেনের সাবেক ভূতাত্ত্বিক প্রধান রোমান ওপিমাখ বলেন, “এটি একটি পুঁজিনির্ভর ও দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প। তবে বর্তমান প্রযুক্তির চাহিদা পূরণ করতে চাইলে গুরুত্বপূর্ণ খনিজের দিকেই নজর দিতে হবে।”
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন