গত বছরের ঈদেও যেখানে পেট্রাপোল স্থলবন্দর এলাকার ব্যবসায় যুক্ত মানুষজন দম ফেলার ফুরসৎ পাননি। কিন্তু এবার কার্যত মাছি মারতে হয়েছে তাদের। দেশ ট্রাভেলস-এর কলকাতা চ্যাপ্টারের মালিক মুহাম্মদ আলি হোসেন শেখ জানান, বরাবর ঈদে আমরা যে ব্যবসা করে থাকি, সেই তুলনায় এবারের অবস্থা খুবই খারাপ।
এমন পরিস্থিতির জন্য তিনি ভারত সরকারকেই দায়ী করছেন। তার কথায়, ভারত সরকার বাংলাদেশিদের জন্য ৬০ শতাংশ টুরিস্ট ভিসা, ৩০ শতাংশ মেডিকেল ভিসা এবং বাকি অন্যান্য ভিসা প্রদান করে থাকে। কিন্তু এবার ভিসা ইস্যু হয়নি বলে আমরা কোনো রকম ব্যবসা পাইনি। আগে রমরমা ব্যবসার সময় প্রতিদিন দেশ ট্রাভেলসের আটটি বাস চলাচল করতো কলকাতার নিউমার্কেট থেকে পেট্রাপোল পর্যন্ত। এখন পর্যটকের অভাবে ওই একই যাত্রাপথে মাত্র একটি বাস চলাচল করে, তা-ও আবার মাসে ১৫ দিন।
মুহাম্মদ আলি হোসেন শেখের দাবি, বর্তমান পরিস্থিতিতে পেট্রাপোল চেকপোস্ট কিংবা কলকাতার নিউমার্কেটে মাত্র দুই শতাংশ ব্যবসা চলছে, বাকি ৯৮ শতাংশই বন্ধ। যাত্রীর সংখ্যা কম, তেল খরচের অর্থও উঠছে না। তাই শ্যামলী এসপি, সোহাগ, এনআর, সৌদিয়া, গ্রীন লাইন, রয়েল কোচসহ প্রতিটি পরিবহন সংস্থাই বাস বন্ধ রেখেছে। কিন্তু মাস কয়েক আগেও তথাকথিত এই ‘ব্যাড প্যাচ’ বা ব্যবসায়িক মন্দা ছিল না। শুরুটা হয় গত ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মধ্যে দিয়ে। ঘটনার আট মাস কেটে গেলেও ক্ষত শুকায়নি। নিরাপত্তা ও কর্মী সংকটের কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশিদের জন্য সাধারণ ভিসা প্রদান বন্ধ রেখেছে ভারত সরকার। মেডিকেল ভিসা চালু থাকলেও তা প্রদানের সংখ্যা খুবই কম। আর সেসবের প্রভাব গিয়ে পড়েছে ব্যবসায়।
পর্যটকের অভাবে যেমন কলকাতার নিউমার্কেটে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অনেক ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন বা অন্য ব্যবসায় ঝুঁকছেন। ঠিক তেমনি অবস্থা খারাপ পেট্রাপোল স্থল বন্দরেও।
বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্রের মালিক বাবলু রায় জানান, বর্তমান পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আগে প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ জন পর্যটক আসতেন। কিন্তু বর্তমান দুই-তিন মাস মিলিয়েও সেই গ্রাহক পাই না। ভিসা সমস্যার কারণে বাংলাদেশের পর্যটক আর সেভাবে আসছে না। আমাদের ব্যবসায় পড়েছে তার প্রভাব। তিনি আরও জানান, বর্তমানে মেডিকেল এবং তীর্থ ভিসা নিয়ে বাংলাদেশি পর্যটকরা কলকাতা ও ভারতে আসছেন। তবে সেই সংখ্যাটা খুবই কম। তার মতে, ট্যুরিস্ট ভিসা যতদিন না চালু হবে ততদিন স্বাভাবিকতা ফিরবে না।
বর্তমান পরিস্থিতিকে লকডাউনের সাথে তুলনা টেনে গ্রীন লাইন পরিবহনের কর্মী সুব্রত ঘোষ জানান, লকডাউনের সময় বুঝতাম সেটা বন্ধ। কিন্তু এখন না খোলা, না বন্ধ। আগে প্রতিদিন প্রতিটি পরিবহন থেকে চারটি করে বাস আসা-যাওয়া করতো। এখন সব পরিবহন একত্রিত হয়ে একটি করে বাস ছাড়া হয়।
পেট্রাপোল সীমান্তে কস্তুরী নামে একটি ভাতের হোটেলের কর্মী প্রসেনজিৎ পাল জানান, আমাদের হোটেলটি মূলত বাংলাদেশি পর্যটকের ওপর নির্ভরশীল। আগে প্রতিদিন ছয় থেকে সাত হাড়ি ভাত রান্না হতো, এখন হয় মাত্র দুই হাড়ি। আগে আয় হতো ১২ হাজার রুপির ওপর, তা নেমে এসেছে দুই হাজারেরও নিচে। বাংলাদেশি পর্যটকদের ওপর নির্ভর করে ভাগ্যের চাকা ঘোরে পেট্রাপোল সীমান্তের এক লটারির টিকিট বিক্রেতারও। চন্দন দত্ত নামে ওই ব্যক্তি জানান, আমার এখানে যেমন স্থানীয় ভারতীয় ব্যবসায়ীরা টিকেট কিনতেন, সেভাবে বাংলাদেশি পর্যটকরাও কিনতেন। অনেক বাংলাদেশি লটারিতে নগদ অর্থও জিতেছিলেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কেবল স্থানীয়দের ওপরেই নির্ভর করতে হয়। আগে যেখানে দৈনিক এক হাজার রুপি আয় হতো, এখন ১০০ রূপিও হয় না।
এ অবস্থায় সবার মনেই একটি প্রশ্ন, কবে ফিরবে স্বাভাবিক অবস্থা? সম্প্রতি দুই দেশের সম্পর্কে শীতলতা আসার পেছনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একাংশকে দায়ী করেছেন পরিবহন ব্যবসায়ী মুহাম্মদ আলি হোসেন শেখ। তার মতে, যেভাবে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে অপপ্রচার ছড়ানো হচ্ছে, তা দুই দেশের সু-সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন