২০২০ সালের ৩০ থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলারের পুরোনো পোশাক ও আনুষঙ্গিক পণ্যের বাজার বর্তমানে ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
একসময় পুরোনো পোশাকের বাজার শুধু দাতব্য সংস্থার দোকানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন এটি মূলধারায় জায়গা করে নিচ্ছে। বিলাসবহুল পোশাক পুনঃবিক্রির প্ল্যাটফর্ম ভেস্তিয়ের কালেক্টিভকে সম্প্রতি জনপ্রিয় নেটফ্লিক্স সিরিজ এমিলি ইন প্যারিস-এর একটি পর্বে তুলে ধরা হয়েছে। বিলাসবহুল পোশাকের জন্য পরিচিত এই সিরিজের মাধ্যমে পুরোনো পোশাকের বাজার আরও আলোচনায় এসেছে। এদিকে অনলাইন মার্কেটপ্লেস ইবে ‘লাভ আইল্যান্ড’ নামে ব্রিটিশ রিয়েলিটি শোর সঙ্গে অংশীদার হয়েছে, যেখানে প্রতিযোগীদের পুরোনো পোশাক পরানো হচ্ছে। এ ছাড়া, গত বছর লন্ডন ফ্যাশন উইকে লিথুয়ানিয়ার পুনঃবিক্রয় প্ল্যাটফর্ম ভিনটেড এবং দাতব্য সংস্থা অক্সফাম পুরোনো পোশাকের সংগ্রহ প্রদর্শন করেছে।
লম্বার্ড ওডিয়ার ব্যাংকের গবেষণা অনুযায়ী, ২০২০ সালের ৩০ থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলারের পুরোনো পোশাক ও আনুষঙ্গিক পণ্যের বাজার বর্তমানে ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে মার্কিন পুনঃবিক্রয় বাজারের প্রবৃদ্ধি সাধারণ পোশাক খাতের তুলনায় ১৫ গুণ বেশি ছিল। চলতি বছর বিশ্বব্যাপী পোশাক শিল্পের বাজারের ১০ শতাংশ পুরোনো পোশাকের দখলে যেতে পারে।
বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ৩০ হাজার নতুন পণ্য ভেস্তিয়ের প্ল্যাটফর্মে তালিকাভুক্ত হচ্ছে। এমন এক সময়, যখন অনেক ফ্যাশন ব্র্যান্ড টিকে থাকার লড়াই করছে, তখন পুরোনো পোশাকের বাজার দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। তবে এই প্রবৃদ্ধির সীমা কতদূর?
অনেকেই পরিবেশগত কারণ বিবেচনায় পুরোনো পোশাক কেনেন। বিশ্বব্যাপী মোট কার্বন নিঃসরণের ১০ শতাংশের জন্য দায়ী ফ্যাশন শিল্প, যা শিপিং ও বিমান পরিবহনের সম্মিলিত নিঃসরণের চেয়েও বেশি। পাশাপাশি, পোশাক উৎপাদনে ব্যাপক পরিমাণ পানি ব্যবহৃত হয়। তবে ভেস্তিয়েরের প্রধান নির্বাহী ম্যাক্সিমিলিয়ান বিটনারের মতে, ক্রেতাদের প্রধান উদ্বেগ হলো দাম। খরচ সাশ্রয়ের জন্যই অনেকে পুরোনো পোশাকের দিকে ঝুঁকছেন। প্ল্যাটফর্মটির তথ্য অনুযায়ী, তাদের মাধ্যমে কেনা ডিজাইনার পোশাক নতুন পোশাকের তুলনায় গড়ে ৩৩ শতাংশ কম দামে পাওয়া যায়। কোটের ক্ষেত্রে এই ব্যবধান ৬৪ শতাংশ এবং পোশাকের ক্ষেত্রে ৭২ শতাংশ। তবে এখনো অনেক সম্ভাবনা বাকি আছে। ওয়েলস ফার্গো ব্যাংকের বিশ্লেষকদের মতে, সাধারণ মানুষের ওয়্যারড্রোবেই আনুমানিক ২০০ বিলিয়ন ডলারের বিলাসবহুল পোশাক রয়েছে, যার মাত্র ৩ শতাংশ প্রতি বছর পুনঃবিক্রয় করা হয়। ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে পুনঃবিক্রয় প্ল্যাটফর্মগুলো প্রক্রিয়াকে আরও সহজ ও সাশ্রয়ী করার চেষ্টা করছে। ২০১৬ সালে ভিনটেড বিক্রেতাদের তালিকাভুক্তি ফি বাতিল করে এবং এখন শুধু ক্রেতাদের কাছ থেকে প্রায় ৫ শতাংশ কমিশন নেয়। গত বছর লন্ডনভিত্তিক সামাজিক বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ডিপপ এবং ইবে একই পদক্ষেপ নেয়। তবে অনেক বিক্রেতার জন্য এই প্রক্রিয়া এখনো জটিল। বিটনার জানান, নিজের চারটি পোশাক বিক্রির জন্য ভেস্তিয়েরে তালিকাভুক্ত করতে তার প্রায় আধা ঘণ্টা সময় লেগেছে। ফলে কিছু প্ল্যাটফর্ম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে পণ্যের বিবরণ ও মূল্য নির্ধারণের মতো কাজগুলো সহজ করার উদ্যোগ নিচ্ছে।
এ ছাড়া, ক্রেতাদের অভিজ্ঞতা উন্নয়নে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। ব্যয়বহুল ডিজাইনার পোশাক কিনতে গিয়ে আসল পণ্য পাওয়া নিশ্চিত করতে চান ক্রেতারা। কিন্তু ম্যানুয়াল যাচাই ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ হওয়ায় নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। ‘ওস্মো’ নামের একটি স্টার্টআপ জুতার গন্ধ শনাক্ত করে তার আসল-নকল যাচাই করে। আরেকটি প্রতিষ্ঠান ‘অর্ড্র’ ব্র্যান্ডগুলোর পোশাক তৈরির সময় ডিজিটাল ফিঙ্গারপ্রিন্ট তৈরি করতে সাহায্য করে, যা পরে সত্যতা যাচাইয়ে কাজে লাগে।
তবে প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি মুনাফা নিশ্চিত করাটাও বড় চ্যালেঞ্জ। লোকসানে থাকা পুনঃবিক্রয় প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রতি বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য কমে আসছে। ২০১৯ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পর থেকে আমেরিকান বিলাসবহুল পুনঃবিক্রয় প্ল্যাটফর্ম দ্য রিয়ালরিয়াল-এর শেয়ারের দাম তিন-চতুর্থাংশ কমেছে। ২০২১ সালে তালিকাভুক্ত থ্রেডআপ-এর শেয়ারের দর ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠান এখনো লাভজনক হতে পারেনি। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ভেস্তিয়েরও এখনো ব্যক্তিমালিকানাধীন, তবে তারা শিগগিরই মুনাফায় ফিরবে বলে আশা করছে।
অন্যদিকে ভিনটেড ২০২৩ সালে লাভের মুখ দেখেছে, যা বিরল ঘটনা। প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব লজিস্টিকস, পেমেন্ট সিস্টেম, সার্ভার ও নিরাপত্তা সফটওয়্যারে বিনিয়োগ করেছে। ভিনটেডের প্রধান নির্বাহী থমাস প্লানটেঙ্গা বলেন, ‘এই অতি সাধারণ কাজগুলোই খরচ কমিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে, যদিও এটি ব্যবসাকে জটিল করে তুলেছে।’
তবে লাভের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হতে পারে প্রতিযোগিতা। এখন শুধু দাতব্য সংস্থা ও অনলাইন মার্কেটপ্লেস নয়, প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডগুলোরাও পুরোনো পোশাক বিক্রির বাজারে প্রবেশ করছে। লুলুলেমন ও দ্য নর্থ ফেস ইতোমধ্যেই পুনঃবিক্রয়ে যুক্ত হয়েছে। অনেক ক্রেতাই এখন টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে পুরোনো পোশাক কিনছেন। শিল্পটি যত বড় হচ্ছে, ততই নতুন খেলোয়াড় যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। প্লানটেঙ্গা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, কোনো বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান একদিন তার ব্যবসাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। তবে আপাতত বহু ওয়ারড্রোব এখনো খালি করার অপেক্ষায় আছে।
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন