MENU
 টিকটকের প্রভাবে পেঙ্গুইনের রাজ্য অ্যান্টার্কটিকায় এখন পর্যটকদের ভিড় – The Finance BD
 ঢাকা     মঙ্গলবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:৩১ অপরাহ্ন

টিকটকের প্রভাবে পেঙ্গুইনের রাজ্য অ্যান্টার্কটিকায় এখন পর্যটকদের ভিড়

  • ০১/০৩/২০২৫

বিশ বছর আগে অ্যান্টার্কটিকায় বছরে ২০ হাজারেরও কম পর্যটক আসত। কিন্তু গত বছর সেখানে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার পর্যটক এসেছে।
দৃশ্যটি অস্বস্তিকর। তিনজন স্প্যানিশ সেনা এবং দুইজন এল পাইস সাংবাদিক ভারী সুরক্ষা স্যুট পরে, জোডিয়াকে করে পেন্ডুলাম কোভে পৌঁছান। এটি একটি সৈকত, যেখানে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি থেকে ধোঁয়া উঠছে এবং এটি অ্যান্টার্কটিক মহাসাগর থেকে বেরিয়ে ডিসেপশন দ্বীপ তৈরি করেছে। তবে, এই শীতল জায়গাটি, যেখানে তাপমাত্রা শূন্যের নিচে, কিন্তু গরম ঝরনা রয়েছে, এখন পর্যটকে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাদের কেউ কেউ মোবাইলে ভিডিও রেকর্ড করছেন, আবার কেউ ইনস্টাগ্রাম ও টিকটকের জন্য পোজ দিচ্ছেন। উপকূলের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে লন্ডন ও নিউইয়র্কের বিনিয়োগ তহবিলের একটি গ্রুপের কেনা বিলাসবহুল ক্রুজ শিপ রোয়াল্ড আমুন্ডসেন। প্রায় ৫০০ যাত্রী রয়েছে ২২ হাজার ডলার পরিশোধ করে ক্রুজ শিপে করে এই দ্বীপে এসেছেন। সেই জাহাজের পিছনে আরও একটি জাহাজ আসছে। তারপর আরেকটি। এভাবে পৃথিবীর শেষ অক্ষত মহাদেশেও পর্যটনের ছোঁয়া লেগেছে।
জীববিজ্ঞানী আন্তোনিও কিসাদা স্পেনের পোলার কমিটির প্রধান ফেব্রুয়ারির কোনো এক দিনে একটি তিমি শিকার স্টেশনের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যায়। ১৯১১ সালে একটি নরওয়েজিয়ান কোম্পানি স্টেশনটি নির্মাণ করেছিল এবং ১৯৩১ সালে তিমির তেলের দাম পড়ে যাওয়ার পর এটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। তিমির তেল একসময় আলো জ্বালানোর জন্য জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হত। এই ধ্বংসাবশেষ এখন এক ধরনের অ্যান্টার্কটিক চেরনোবিল। উপসাগরটি এখনও বিশাল তিমির হাড়ে ভর্তি। সৈকতের পাশে রয়েছে তিমি শিকারিদের ভাঙা ঝুপড়ি, বিশাল ধাতব তেল সংরক্ষণ ট্যাংক এবং ৩৫টি কবর সহ একটি সমাধির ধ্বংসাবশেষ। যুক্তরাজ্য এই খালি আশ্রয়স্থলগুলো ব্যবহার করে একটি বৈজ্ঞানিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু ১৯৬৯ সালে এক আগ্নেয় বিস্ফোরণে সেগুলো ধ্বংস হয়ে যায় এবং গবেষকরা পালাতে বাধ্য হন। তবুও, ডিসেপশন দ্বীপ এখন অ্যান্টার্কটিকার অন্যতম সর্বাধিক ভ্রমণকৃত স্থান এবং এখানেই ১৯৮৯ সাল থেকে স্পেনের সেনাবাহিনী গাব্রিয়েল ডি কাস্তিলা ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করেছে। আরেকটি ক্রুজ শিপ দেখতে পাওয়ার পর কিসাদা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
কিসাদা বলেন, “পর্যটন একটি অপেক্ষাকৃত নতুন ঘটনা। বিশ বছর আগে অ্যান্টার্কটিকায় বছরে ২০ হাজারেরও কম পর্যটক আসত। কিন্তু গত বছর সেখানে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার পর্যটক এসেছে। এটি হয়ত পুরো মহাদেশের জন্য ছোট মনে হতে পারে, যা ইবেরীয় উপদ্বীপের চেয়ে ২৬ গুণ বড়, তবে বেশিরভাগ পর্যটক একই জায়গায় আসেন।”এমন সময় তার পেছনে একটি ভূতুড়ে দল তিমি শিকার স্টেশনের তুষারের নিচে হেঁটে চলে, যা আগ্নেয়গিরির আঘাতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পর্যটকরা স্প্যানিশ সেনা ও বিজ্ঞানীদের উপস্থিতি দেখে চমকে যান, যারা অ্যান্টার্কটিক গ্রীষ্মকালে উপসাগরের ওপর প্রান্তে গাব্রিয়েল ডি কাস্তিলা ঘাঁটিতে অবস্থান করেন। সিলভার ক্লাউড নামক ক্রুজ শিপে করে আসা একজন আমেরিকান মহিলা বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেন, “আপনি এখানে থাকেন?” জাহাজটিতে বাহামাসের পতাকা উড়ছিল এবং এখন পেঙ্গুইন ও সীলদের মধ্য দিয়ে সেটি যাচ্ছিল।
অস্ট্রেলিয়ার ভূতাত্ত্বিক অ্যান হার্ডি ইতোমধ্যে একটি টিকটক প্রভাবের কথা বলেছেন, যেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের শত কোটি ব্যবহারকারী অ্যান্টার্কটিকার বিভিন্ন জায়গায় পর্যটকদের অদ্ভুত ভিডিও দেখে আকৃষ্ট হচ্ছেন। এসব ভিডিওতে দেখা যায়– আইসবার্গের মধ্যে ডিজেদের সঙ্গে নাচ, পানীয় বানানোর জন্য বরফ ভাঙা, পেঙ্গুইনের পোশাক পরা অবস্থায় সাঁতার কাটা এবং চমৎকার দৃশ্যের মধ্যেই ক্রুজ শিপের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া। বর্তমানে অ্যান্টার্কটিকায় একদিনে একটি ম্যারাথন দৌড়ানো, কাঠের নৌকা চালানো, ৫০ হাজার ডলার খরচ করে এর সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করা থেকে শুরু করে পার্টিতে অংশগ্রহণও করাও সম্ভব। এর পাশাপাশি, ইলন মাস্কের স্টারলিংক স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ভিডিও রিয়েল-টাইমে শেয়ার করা সম্ভব হচ্ছে, যা পূর্বে পৃথিবীর অন্য স্থানগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল না। তাসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হার্ডি বলেন, এই টিকটকের প্রভাব পর্যটন বাড়ানোর পাশাপাশি “অপ্রয়োজনীয় আচরণকেও উৎসাহিত করছে, যা অ্যান্টার্কটিক পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে বা আক্রমণাত্মক প্রজাতি নিয়ে আসতে পারে।” মাত্র এক বছরে দর্শনার্থীদের সংখ্যা ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ তাত্ত্বিকভাবে প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকা হিসেবে সুরক্ষিত এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য উৎসর্গিত। অ্যান্টার্কটিক চুক্তি নামক একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি এই মহাদেশে শুধু দুটি অর্থনৈতিক কার্যক্রম অনুমোদন দেয়– মৎস্য শিকার, যার জন্য খুব কঠোর নিয়ম রয়েছে; এবং পর্যটন, যা এখনও নিয়ন্ত্রিত নয়। স্পেনের এই মহাদেশে দুটি ঘাঁটি রয়েছে। এটি অ্যান্টার্কটিক চুক্তিতে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা থাকা ২৯টি দেশের মধ্যে একটি। কিসাদা সেই টেবিলে বসে আছেন, যেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তিনি বলেন, “এখন আমরা পর্যটন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। একটি বিকল্প হতে পারে পর্যটকদের কাছ থেকে অ্যান্টার্কটিকা সংরক্ষণে সাহায্যের জন্য সামান্য পরিমাণ অর্থ নেওয়া।” এই কাল্পনিক কর আগামী জুনে চুক্তির পরবর্তী সভায় বাস্তবায়িত হতে পারে।
সমুদ্রবিজ্ঞানী আন্তোনিও তোভার ২৯ জানুয়ারি আরেকটি অবিশ্বাস্য দৃশ্যের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তিনি পরিত্যক্ত তিমি শিকার স্টেশনের সামনে পানির নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন এবং সেখানে প্রায় একশ জনকে সাঁতারের পোশাক পরে উদগ্রীবভাবে নিজেদের ভিডিও তৈরি করতে দেখেন। তাদের পিছনে ডাচ ক্রুজ শিপ হন্ডিয়াস উপকূলের কাছে নোঙর করা ছিল। তোভার বলেন, “এত সব পর্যটক যদি সাঁতার কাটতে থাকে এবং সম্ভবত এক বিশাল পরিমাণ সানক্রিম ছাড়ে, তাহলে তা পরিবেশ ব্যবস্থার জন্য একটি স্পষ্ট ঝুঁকি।” তোভার স্প্যানিশ ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলের (সিএসআইসি) জাহাজ সারমিয়েন্তো দে গাম্বোয়াতে করে স্প্যানিশ অ্যান্টার্কটিক অভিযানে অংশগ্রহণ করেছেন।
এই বিশেষজ্ঞ জাহাজের ডেকে একটি সহজ পরীক্ষা পরিচালনা করছেন। প্রায় ১৫টি স্বচ্ছ ব্যাগে তিনি সমুদ্রের পানি সংগ্রহ করেছেন, যার মধ্যে সানক্রিম এবং ক্রিল [একটি ক্ষুদ্র চিংড়ি জাতীয় জলজ প্রাণী] এর বিভিন্ন ঘনত্ব রয়েছে। এই ক্রিল তিমি, সীল এবং পেঙ্গুইনের খাদ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে বেশি পরিমাণের সানক্রিমের প্রভাবে ছোট ছোট প্রাণীগুলো মারা যাচ্ছিল।

তোভার আন্দালুসিয়ার মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউট থেকে প্রকৃতিতে সানক্রিমের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করা ব্যক্তিদের মধ্যে প্রথম ছিলেন। দশকখানেক আগে তিনি এবং তার সহকর্মীরা সতর্ক করেছিলেন, ত্বক সুরক্ষাকারী উপকরণগুলোর বাড়তি ব্যবহার মালোর্কার সৈকতে মাইক্রোঅ্যালগির ওপর বিষাক্ত প্রভাব ফেলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই রাজ্য ইতোমধ্যে এমন সানক্রিম নিষিদ্ধ করেছে, কারণ এর উপাদানগুলো প্রবাল প্রাচীরকে ধ্বংস করে। এই গবেষক সতর্ক করে বলেন, “অ্যান্টার্কটিকায় সবকিছু এত অক্ষত, এত সংবেদনশীল এবং এত কম প্রভাবিত যে, মানুষের কাছ থেকে যেকোনো ছোট প্রভাবও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।”
স্প্যানিশ নৌবাহিনীর সামুদ্রিক গবেষণা যান হেস্পেরিদেস ২০ নভেম্বর কারতাজেনা থেকে অ্যান্টার্কটিকার উদ্দেশে যাত্রা করে। এর কমান্ডার ফ্রিগেট ক্যাপ্টেন ফার্নান্দো মোলিনে জাস্তে ডিসেপশন দ্বীপের পরিত্যক্ত তিমি শিকার স্টেশন কমপ্লেক্সে সাত মিটার লম্বা একটি বিশাল গ্রাফিতি দেখতে পেয়ে হতবাক হন। আন্তর্জাতিক অ্যান্টার্কটিকা ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন নিজেদের “স্তম্ভিত এবং লজ্জিত” বলে ঘোষণা দিয়েছে এবং নিশ্চিত করেছে, এই “অহেতুক ভ্যান্ডালিজম” তাদের কোনো ক্রুজ শিপ যাত্রী ঘটায়নি। ছোট জাহাজগুলোও এই এলাকায় কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই ভ্রমণ করে এবং ঐতিহাসিক শিল্পকর্মের চুরি হওয়ার রিপোর্টও পাওয়া গেছে।
মিয়ামি সমুদ্র সৈকতভিত্তিক ট্রাভেল এজেন্সি অ্যান্টার্কটিকা ক্রুজেস বিভিন্ন ধরনের ক্রুজের টিকিট বিক্রি করে, যার মধ্যে রয়েছে রোয়াল্ড আমুন্ডসেন। এর টিকিটের মূল্য ৫০ হাজার ডলারেরও বেশি। এই ক্রুজের একটি বিলাসবহুল কেবিনে ১৮ দিনের যাত্রার জন্য এই মূল্য দিতে হয়। ,এছাড়া, হন্ডিয়াসের মত সাধারণ ক্রুজ শিপে ভ্রমণ করতে খ্রচ করতে হয় প্রায় ১০ হাজার ডলার। এজেন্সির মুখপাত্র জন পার্কার বলেন, জাহাজগুলো ক্রুজ অপারেটরদের অ্যাসোসিয়েশন এবং অ্যান্টার্কটিকা চুক্তির নির্দেশিকা অনুসরণ করে, যেমন একই স্থানে একাধিক ক্রুজ এড়িয়ে চলা, প্রতি সৈকতে এক সময়ে সর্বোচ্চ ১০০ জন পর্যটকে সীমাবদ্ধ থাকা এবং প্রতি ২০ জন যাত্রীর জন্য অন্তত এক জন গাইড থাকা। পর্যটকদের পেঙ্গুইন, সীল এবং সি লায়নের পাঁচ মিটারের কাছাকাছি না যেতে বলা হয়।
আন্তোনিও কিসাদা বর্তমানে জাতীয় অ্যান্টার্কটিক প্রোগ্রাম ম্যানেজারদের কাউন্সিলের সভাপতি। তিনি বলেন, “বড় গ্রাফিতি” নিয়ে তদন্ত চলছে এবং সন্দেহ করা হচ্ছে, একটি ব্যক্তিগত নৌকা চালানো রুশ নাগরিক এর সাথে জড়িত। কিসাদা তিমি শিকারিদের কবরস্থানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে অবশেষে একটি পরিত্যক্ত ব্রিটিশ হ্যাঙ্গারের কাছে পৌঁছান।
“এখানেই গ্রাফিতিটি ছিল,” তিনি ঘোষণা করেন। এটি ভাবা কঠিন যে কোনো ব্যক্তি পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক সাগর পাড়ি দিয়ে উজ্জ্বল রঙের স্প্রে ক্যান নিয়ে এসেছিল, শুধু এই সংরক্ষিত ঐতিহাসিক স্থানটিতে স্প্রে পেইন্টিং করতে। যুক্তরাজ্য অ্যান্টার্কটিক হেরিটেজ ট্রাস্ট (ইউকেএএইচটি) ফাউন্ডেশন অ্যান্টার্কটিকায় ব্রিটিশ অভিযাত্রীদের অবশেষ সংরক্ষণের জন্য কাজ করে। ফেব্রুয়ারির শুরুতে ইউকেএএইচটি গ্রাফিতি পুরোপুরি মুছে ফেলার ব্যবস্থা নেয়। কিসাদা ক্ষোভের সাথে সতর্ক করেন, “পর্যটন অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবং এটি অনিয়ন্ত্রিত ও ভুলভাবে গড়ে ওঠা পর্যটনের একটি মারাত্মক উদাহরণ।”

ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

Leave a Reply




Contact Us