চীনের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের বড় অংশজুড়ে রয়েছে মার্কিন ট্রেজারি বন্ড। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি বন্ডে বিনিয়োগকারী দেশগুলোর মধ্যে চীনের অবস্থান দ্বিতীয়।
মার্কিন অর্থ বিভাগের দেয়া তথ্যানুসারে, গত বছর চীন সরকারের কাছে থাকা মার্কিন জাতীয় ঋণ ২০২৩ সালের তুলনায় ৫ হাজার ৭০০ কোটি ডলার কমে দাঁড়িয়েছে ৭৫ হাজার ৯০০ কোটি ডলারে। তবে অন্য দেশের অ্যাকাউন্টে থাকা চীনা মালিকানাধীন মার্কিন বন্ড এ পরিসংখ্যানের অন্তর্ভুক্ত নয়।
বিশ্লেষকদের মতে, চীন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৈচিত্র্যময় করতে স্বর্ণের মতো সম্পদ কিনছে। যার প্রভাব পড়েছে মার্কিন ট্রেজারি হোল্ডিংয়ের বিনিয়োগে। তবে বেইজিং প্রকৃত চিত্র আড়াল করতে কিছু বন্ড অন্য দেশে নিবন্ধিত কাস্টডিয়ান অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করছে।
বিনিয়োগে বৈচিত্র্য আনার ধারণাটি বেইজিংয়ে বেশ পুরনো বলে মন্তব্য করেন মার্কিন গবেষণা সংস্থা কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের সিনিয়র ফেলো ও সাবেক ট্রেজারি কর্মকর্তা ব্র্যাড সেটসার। এর অন্যতম কারণ দেশ দুটির মধ্যকার ভূরাজনৈতিক টানাপড়েন। এ গবেষক বলছেন, ‘মার্কিন ট্রেজারি বন্ড রাখা ঝুঁকিপূর্ণ— ২০১০ সালের দিকে এ সিদ্ধান্তে আসে চীন। কারণ বিপুল পরিমাণ সম্পদ ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতে থাকা নিশ্চয়ই ভালো দেখায় না!’
তবে মার্কিন অর্থ বিভাগের পরিসংখ্যান নিয়ে ব্র্যাড সেটসারের সন্দেহ রয়েছে। তার ভাষ্যে, চীনের মার্কিন ট্রেজারি হোল্ডিং কমার হার অতিরঞ্জিত হতে পারে। কারণ কিছু সম্পদ বেলজিয়ামের ইউরোক্লিয়ার ও লুক্সেমবার্গের ক্লিয়ারস্ট্রিমের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর হয়েছে। ফলে সরকারি রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে, ওই দেশগুলোর ট্রেজারি হোল্ডিং বেড়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চীন কী করছে এবং তাদের অর্থ প্রবাহ বিশ্ববাজারে কীভাবে প্রভাব ফেলছে তা অনুসরণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
পরিসংখ্যানের লুকোচুরি যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি বিশ্ব বাজারের জন্যও বিভ্রান্তিকর। কারণ এটি বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির স্থিতিশীলতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। মার্কিন সরকার এ পরিবর্তন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে। কারণ দেশটিকে অনেক অর্থ ঋণ নিতে হয়। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সরকারি ঋণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। চীন বা জাপানের মতো বড় বিনিয়োগকারীরা বন্ড বিক্রি করলে মার্কিন ট্রেজারির চাহিদা কমে যাবে। ফলে অন্যদের আকৃষ্ট করতে উচ্চ সুদহার দিতে হবে, যা মার্কিন অর্থনীতির জন্য ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে।
প্রতিবেদন অনুসারে, চীনের ধারণ করা মার্কিন ট্রেজারি ২০১১ সালে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছার পর থেকে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি ডলার কমেছে। বিপরীতে ২০২৪ সালে যুক্তরাজ্যের হোল্ডিং ৩ হাজার ৪২০ কোটি, বেলজিয়ামের ৬ হাজার ২০ কোটি ও লুক্সেমবার্গের ৮ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বেড়েছে। এছাড়া ১ লাখ কোটি ডলারেরও বেশি মার্কিন ট্রেজারি বন্ড নিয়ে এগিয়ে জাপান।
চীনের বৈদেশিক রিজার্ভের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেন, ‘চীনের কাছে থাকা সব মার্কিন ট্রেজারি বন্ড সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষিত নয়। ঝুঁকি বৈচিত্র্যকরণের উদ্দেশে ইউরোক্লিয়ার বা ক্লিয়ারস্ট্রিমের মতো সংস্থার মাধ্যমে রিজার্ভের একটি অংশ ধারণ করে দেশটি। তবে চীনের মোট মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের মালিকানা ধীরে ধীরে কমবে এ প্রবণতা স্পষ্ট।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকবিষয়ক গবেষণা সংস্থা অফিশিয়াল মনিটারি অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস ফোরামের মার্কিন প্রধান মার্ক সোবেল বলেন, ‘চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থনৈতিক ও বাজারের অস্থিরতার সময় নিরাপদ বলে বিবেচিত স্বর্ণের মতো অন্যান্য সম্পদে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে।’
চলতি বছর এখন পর্যন্ত স্বর্ণের দাম প্রায় ১২ শতাংশ বেড়েছে, যা বড় ক্রেতাদের মধ্যে চাহিদা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষ তিন মাসে চীন ছিল তৃতীয় বৃহত্তম স্বর্ণ ক্রেতা, তাদের রিজার্ভে যোগ হয়েছে আরো ১৫ দশমিক ২৪ টন স্বর্ণ। তবে দুই বছরে পিপলস ব্যাংক অব চায়নার (পিবিওসি) স্বর্ণের মজুদ ১৩ শতাংশ বাড়লেও এটি এখনো মোট রিজার্ভের ছোট একটি অংশ। মার্ক সোবেলের মতে, চীনের রিজার্ভে মার্কিন ট্রেজারি বন্ড কমার অর্থ এ নয়, দেশটি ডলারভিত্তিক সম্পদ থেকে পুরোপুরি সরে আসছে। বরং এজেন্সি বন্ডের মতো অন্যান্য নিরাপদ মার্কিন ঋণে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে তারা।
এদিকে যুক্তরাজ্যে ট্রেজারি হোল্ডিং বৃদ্ধি সম্পর্কে বিশ্লেষকরা বলেন, ‘মূলত বিদেশী সার্বভৌম সম্পদ তহবিল, ধনী পরিবার ও হেজ ফান্ডের মাধ্যমে লন্ডনের অর্থ প্রবাহের কারণে মার্কিন বন্ডে বিনিয়োগ বাড়ছে। একই ধরনের প্রবণতা বেলজিয়ামেও দেখা গেছে।’ বিনিয়োগ সংস্থা নাটঅ্যালায়েন্সের আন্তর্জাতিক ফিক্সড ইনকামের প্রধান অ্যান্ডি ব্রেনার বলেন, ‘যেহেতু যুক্তরাজ্যের গিল্টসের (সরকারি বন্ড) ওপর সুদহার ট্রেজারি বন্ডের তুলনায় বেশি, তাই যুক্তরাজ্যে ট্রেজারির ক্রেতারা ব্রিটিশ বিনিয়োগকারী হওয়ার সম্ভাবনা কম। বরং এটি প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগকারীদের অর্থ প্রবাহের সঙ্গে সম্পর্কিত।’
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন