দুবাইভিত্তিক কন্টেইনার জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা ‘ফিডার লাইনস ডিএমসিসি’ নতুন এই সেবা চালু করেছে
চট্টগ্রাম বন্দর এবং পাকিস্তানের করাচি বন্দরের মধ্যে সমুদ্রপথে সরাসরি জাহাজ যোগাযোগ চালু হওয়ায় দুইদেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধির আশা করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
দুবাইভিত্তিক কন্টেইনার জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা ‘ফিডার লাইনস ডিএমসিসি’ নতুন এই সেবা চালু করেছে। সংস্থার পরিচালনায় ইতোমধ্যে সরাসরি চট্টগ্রাম থেকে করাচি বন্দরে দুটি সফল সমুদ্রযাত্রা সম্পন্ন হয়েছে। এতে বাণিজ্যের সময় এবং খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে কন্টেইনারবাহী পণ্য কলম্বো, সিঙ্গাপুর, দুবাইসহ বিভিন্ন বন্দর ঘুরে চট্টগ্রাম বন্দরে আসতে সময় লাগে ২০ দিনেরও বেশি। কিন্তু করাচি-চট্টগ্রাম রুটে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হওয়ায় এখন সময় লাগছে মাত্র ১১ দিন।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার এসোসিয়েশন-বাফার এর ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল আলম সুজন টিবিএসকে বলেন, “পাকিস্তান থেকে আমদানি পণ্য দুবাই, সিঙ্গাপুর, কলম্বোসহ বিভিন্ন বন্দর ঘুরে চট্টগ্রাম বন্দরে আসতো। ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে জট তৈরি হলে পণ্য পৌঁছাতে ২০ দিন থেকে কখনো কখনো প্রায় ১ মাসও সময় লেগে যেতো। আমদানি পণ্য কত দিনের মধ্যে আমদানিকারকের কাছে পৌঁছবে সেটি নিয়ে কোনো নিশ্চয়তা ছিল না।”
“সরাসরি এই রুটে পণ্য পরিবহন চালু হওযায় এখন পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা আগ্রহী হবেন। সময়ের সাথে খরচের একটি সম্পর্ক রয়েছে। সময় কম লাগায় অবশ্যই খরচ কমে আসবে,” যোগ করেন তিনি।
পানামার পতাকাবাহী ‘ইউয়ান জিয়াং ফা ঝং’ নামের জাহাজটি করাচি বন্দর থেকে গতকাল দ্বিতীয়বারের মতো পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছেছে। এবার ৮২৫ টিইইউ (বিশ ফুট সমতুল্য ইউনিট) পণ্য নিয়ে এসেছে জাহাজটি— যা প্রথম বারের চালানের তুনলায় দ্বিগুণেরও বেশি।
এবারের পণ্যের মধ্যে রয়েছে— চিনি, সোডা অ্যাশ, ডেনিম ফেব্রিক, সুতো, ডলোমাইট লুম্পস, ন্যাচারাল ডলোমাইট, ড্রাই ফিশ (শুঁটকি), ইউপিএস, আলু, রেডিয়েটর কোর ইত্যাদি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, চট্টগ্রাম-করাচি এই রুটে জাহাজ চালু হওয়ায় এখন আমদানিকারকরা একটি নির্দিষ্ট সময়ে মধ্যে পণ্য পাওয়ার নিশ্চয়তা পেয়েছেন। বিশেষ করে, শিল্পের কাঁচামাল আমদানিকারকরা এখন একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্য হাতে পাওয়ার নিশ্চয়তা পাবেন। এর ফলে পাকিস্তানে আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ আরও বাড়বে।
কর্ণফুলী লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক আনিস উদ দৌলা টিবিএসকে বলেন, “প্রথম ভয়েসের (সমুদ্রযাত্রা) চেয়ে দ্বিতীয় ভয়সে দ্বিগুণেরও বেশি পণ্য আসার মধ্যে আমরা ব্যবসায়ীদের সাড়া দেখছি। পাকিস্তান থেকে পণ্য আসতে জাহাজের সেকেন্ড কানেকশন পেতে আগে অনেক সময় অপেক্ষায় থাকতে হতো ব্যবসায়ীদের। এখন সেই দুশ্চিন্তা আর নেই। আমরা আশাবাদী পরবর্তী ভয়েসগুলোতে আমদানি পণ্যের পরিমাণ আরও বাড়বে।”
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে বছরে আমদানি বাণিজ্য ৭৪.৪৫ লাখ ডলারের। এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ আমদানি পণ্য রয়েছে তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল এবং প্রস্তুত চামড়া। এছাড়া সিমেন্ট ক্লিংকার, ফলমুল এবং থ্রিপিস আমদানি হয়।
বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয় বছরে প্রায় ৬.২৬ কোটি ডলারের পাট, ওষুধ, হাইড্রোজেন, চা ও তৈরি পোশাক পণ্য। গত অর্থবছরে পাকিস্তান থেকে মোট আমদানি পণ্যের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ টন, এরমধ্যে কনটেইনারে আনা হয়, এমন পণ্যের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ টনের কম। ২০২১-২২ অর্থবছরে পাকিস্তান থেকে আমদানি পণ্যের দাম ছিল ৮০ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান শফিকুল আলম জুয়েল টিবিএসকে বলেন, চট্টগ্রাম-পাকিস্তান সরাসরি জাহাজ চলাচলের কারণে আমদানি পণ্যের পরিমাণ বেড়েছে। একই সাথে বাড়বে পাকিস্তানে পণ্য রপ্তানিতেও।
তিনি বলেন, “এটি আমাদের দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই ভালো। তবে মাঝ পথে এই সার্ভিস যাতে বন্ধ না হয়ে যায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে এক পণ্য আমদানির ঘোষণা দিয়ে অন্য পণ্য আসছে কি-না, সেটি নিশ্চিত করাও জরুরি।”
তিনি আরও বলেন, “সময় যত কম লাগবে, পণ্য আমদানি খরচ তত কমে যাবে। কারণ সময় বেশি লাগার কারণে এলসি ভ্যালু কম লাগবে, বিশেষ করে এলসি ইন্টারেস্ট কম লাগবে। দ্রুত ক্রেতার কাছে পণ্য গিয়ে বিনিয়োগ তুলে আনতে পারবে। এতে ক্রেতা এবং আমদানিকারক উভয়েই লাভবান হবেন।”
পণ্যের কায়িক পরীক্ষার শর্তে শিথিলতা
আগে পাকিস্তান থেকে পণ্য আসার পরে, তা খালাসের সময়ও নানামুখী জটিলতায় পড়তে হতো। বিশেষ করে, পাকিস্তান থেকে আসা সব ধরনের পণ্য খালাসের আগে কায়িক পরীক্ষা করতো কাস্টম।
এতে করে একদিকে পণ্য আসতে সময় লাগতো বেশি, অন্যদিকে খালাসের এমন বিড়ম্বনার কারণে আমদানিকারকরা পাস্তিানের বিষয়ে তেমন আগ্রহী হতেন না বলে জানান সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা।
তবে আওয়ামী লীগের পতনের পর অন্তবর্তী সরকার পাকিস্তানের আমাদনি পণ্য খালাসে জটিলতা দূর করে। দুই দেশের মধ্যে ব্যবসায়ের সুবিধার্থে পাকিস্তান থেকে আমদানি করা সকল পণ্যের ওপর থেকে বাধ্যতামূলক শতভাগ ‘ফিজিকাল এক্সামিনেশন’ বা কায়িক পরীক্ষার শর্ত প্রত্যাহার করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
“এই শর্ত প্র্যাহারের ফলে এখন অন্যান্য দেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বিবেচনায় যেভাবে পরীক্ষা করা হয়, পাকিস্তান থেকে আমদানির ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাজস্ব বোর্ডের জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এনবিআরের এমন নির্দেশনার প্রায় দেড় মাস পর পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে আমাদনি পণ্য নিয়ে গত ১১ নভেম্বর প্রথমবার পানামা পতাকাবাজী জাহাজ ইউয়ান জিয়াং ফা ঝং চট্টগ্রামে পৌঁছায়।
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন