দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউজে প্রবেশের আগেই শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়ে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় তৈরি করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নভেম্বরের শেষ দিকে ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের বিরুদ্ধে
দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউজে প্রবেশের আগেই শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়ে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় তৈরি করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নভেম্বরের শেষ দিকে ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট শুল্কচাপের ঘোষণাও দিয়েছেন। এছাড়া মার্কিন প্রযুক্তি স্থানান্তরে বেইজিংয়ের ওপর বিধিনিষেধ নতুন কোনো ইস্যু নয়। এসব বিষয় নিয়ে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুর আগে মন্তব্য করলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। সতর্কবার্তা দিয়ে তিনি বললেন, ‘শুল্ক বা প্রযুক্তি যুদ্ধে কোনো পক্ষই জয়ী হবে না।’
বেইজিংয়ে গত মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থার ১০ শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকে এ মন্তব্য করেন চীনা প্রেসিডেন্ট। সাধারণত এ ধরনের পরিস্থিতিতে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের রীতি রয়েছে। তবে এর পরিবর্তে এবারই প্রথম বিশ্বের সামনে ওয়াশিংটনের প্রতি বেইজিংয়ের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরলেন শি জিনপিং।
৬ ডিসেম্বর সম্প্রচারমাধ্যম এনবিসিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, শি জিনপিংয়ের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানে বেইজিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলেও আশা ব্যক্ত করেন ওই সময়। তবে যোগাযোগের সত্যতা নিশ্চিত বা অস্বীকার করেনি বেইজিং। সব মিলিয়ে নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিরঙ্কুশ জয়ের পর দুজনের মধ্যে যোগাযোগের প্রথম কোনো খবর এটি।
শি জিনপিং বলেন, ‘মার্কিন সরকারের সঙ্গে সংলাপ, সহযোগিতা বাড়াতে এবং পারস্পরিক মতপার্থক্যের ব্যাপারে যৌক্তিক অবস্থান গ্রহণ করতে প্রস্তুত চীন।’
এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মতো প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা। গ্রেট হল অব দ্য পিপলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শি জিনপিং বলেন, ‘শুল্ক যুদ্ধ, বাণিজ্য যুদ্ধ ও প্রযুক্তি যুদ্ধ ঐতিহাসিক প্রবণতা ও অর্থনৈতিক আইনবিরোধী এবং এগুলোয় কোনো জয়ী নেই।’
চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়া জানিয়েছে, বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে নিজেদের নীতি বজায় রাখার ওপর জোর দেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তিনি বলেন, ‘চীন সব সময় নিজস্ব বিষয়ের ওপর মনোযোগ দেবে এবং তার সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের স্বার্থ দৃঢ়ভাবে রক্ষা করবে। একই সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে অতি উদার থাকার রীতি পরিবর্তিত হবে না।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, শি জিনপিংয়ের বক্তব্য বোঝায় যে বেইজিং উত্তেজনা বাড়াতে অনিচ্ছুক। কিন্তু একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠলে পাল্টা ব্যবস্থা নিতেও প্রস্তুত।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্য ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে মার্কিন নীতি থেকে ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২০ জানুয়ারি নতুন প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নেয়ার পর বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ সম্প্রসারিত হবে। এর প্রভাব বৈশ্বিক বাণিজ্যে গড়াবে বলেও আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের। নির্বাচনী প্রচারে রিপাবলিকান প্রার্থী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, চীন থেকে আমদানীকৃত পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ বা তার বেশি শুল্ক আরোপ করবেন। এরপর গত মাসে তিনি জানান, চীনের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক এবং কানাডা ও মেক্সিকো থেকে আমদানীকৃত সব পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ কর আরোপ করবেন, যা তার প্রথম দিকের নির্বাহী আদেশের একটি হবে।
গত সোমবার মার্কিন চিপ নির্মাতা এনভিডিয়ার বিরুদ্ধে একচেটিয়া বাণিজ্যবিরোধী আইন লঙ্ঘনের সন্দেহে তদন্তের ঘোষণা দিয়েছে চীন। এ তদন্তকে চীনা চিপ খাতের ওপর ওয়াশিংটনের সাম্প্রতিক বিধিনিষেধের প্রতিশোধ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর পরদিনই শি জিনপিং বললেন, ‘বাণিজ্য যুদ্ধে কোনো পক্ষই জয়ী হবে না।’
মহামারী-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় এখনো পিছিয়ে রয়েছে চীন। আবাসন খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধীরগতির প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে। তবে দেশটির নেতারা অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী সুর বজায় রেখেছেন। এর মাঝে বিধিনিষেধের হুমকিসহ ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে ফিরছেন।
দেশটির সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ কমিউনিস্ট পার্টির পলিট ব্যুরো গত সোমবার এক বৈঠকে বসে। সেখান থেকে বলা হয়, ২০২৪ সালের জন্য চীনের মূল অর্থনৈতিক ও সামাজিক লক্ষ্যগুলো অর্জিত হবে। একই বৈঠক থেকে ১৪ বছরের মধ্যে প্রথমবার মুদ্রানীতি পরিবর্তনের ঘোষণাও এসেছে। চীনের অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের মৌলিক প্রবণতা অপরিবর্তিত রয়েছে বলে ৬ ডিসেম্বরে এক সিম্পোজিয়ামে জানান শি জিনপিং। তিনি বলেন, ‘আমাদের কৌশলগত দৃষ্টি বজায় রাখা এবং আন্তর্জাতিক স্তরে দেশের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে উদ্যোগ নেয়া উচিত।’
মঙ্গলবারের আলোচিত বৈঠকে শি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে ‘স্থিতিশীল, সবল ও টেকসই’ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিতে ইচ্ছুক চীন। যুক্তরাষ্ট্রও একই পথে কাজ করবে বলে আশা করেন তিনি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিনন্দন বার্তা এবং গত মাসে পেরুর লিমায় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে আলাপেও একই বার্তা দিয়েছিলেন শি জিনপিং।
শি স্পষ্টভাবে জানান, বাইডেন প্রশাসনের ‘স্মল ইয়ার্ড, হাই ফেন্স’ নীতি এবং কিছু রিপাবলিকান নেতা উত্থাপিত ‘ডিকাপলিং’ নীতির বিরুদ্ধে তার অবস্থান। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের সুরক্ষাবাদী অবস্থানের স্পষ্ট বিরোধী তিনি। সতর্ক করে বলেন, ‘এ উদ্যোগগুলো নিজের উপকার না করে অন্যদের ক্ষতি করবে।’
তার মতে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেশগুলোর পারস্পরিক নির্ভরতা অর্জন প্রয়োজন। একে ঝুঁকি হিসেবে নয়, ইতিবাচক বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। এতে দুই পক্ষেই ‘উইন-উইন’ পরিস্থিতি তৈরি হয়।
এদিকে সিনহুয়ার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি বছরের জন্য চীনের জিডিপি লক্ষ্য ৫ শতাংশ থাকলেও তা অর্জন হবে কিনা উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
খবর সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন