নির্বাচনে ভোটারদের সমর্থন পেতে সুরক্ষাবাদী নীতি প্রচার করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যার অন্যতম হলো বৈদেশিক বাণিজ্যে বড় ধরনের শুল্ক আরোপ।
নির্বাচনে ভোটারদের সমর্থন পেতে সুরক্ষাবাদী নীতি প্রচার করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যার অন্যতম হলো বৈদেশিক বাণিজ্যে বড় ধরনের শুল্ক আরোপ। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিতে হোয়াইট হাউজে দায়িত্ব নেয়ার আগেই গত সপ্তাহে একাধিক দেশের ওপর বাণিজ্য বাধা তৈরির সুনির্দিষ্ট ঘোষণাও দিয়েছেন। এতে বড় ধরনের বাণিজ্যযুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর বিপরীতে ইউরোপিয়ান কমিশনের নতুন শিল্প ও প্রযুক্তিবিষয়ক প্রধান ‘ইউরোপ ফার্স্ট’ কৌশল প্রস্তাব করেছেন। তার লক্ষ্য হলো ট্রাম্পের সিদ্ধান্তজনিত বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধে ইউরোপীয় ব্লককে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করা।
আসন্ন বাণিজ্যযুদ্ধ নিয়ে এফটির সঙ্গে আলাপ করেন ইউরোপিয়ান কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট স্তেফান সেজর্নে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত স্তেফান একসময় দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। তার মতে, ইউরোপকে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে কৌশলগত আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নিতে হবে। চীন থেকে বড় অংকের ভর্তুকিযুক্ত আমদানি পণ্য সয়লাব হওয়ায় স্থানীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, একেও বাধা দিতে হবে।
স্তেফান সেজর্নে বলেন, “আমি মূলত বিশ্বাস করি, বিশ্বের প্রতি উন্মুক্ত থাকার মধ্যে ইউরোপের অনেক কিছু অর্জন করার আছে। কিন্তু যখন চীন বলছে ‘মেড ইন চায়না’ অথবা যুক্তরাষ্ট্র বলছে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’, তখন আমাদের বলতে হবে ‘মেড ইন ইউরোপ’ অথবা ‘ইউরোপ ফার্স্ট’।”
নতুন এ ইইউ কমিশন পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ব্লকটির অবস্থান পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু দায়িত্ব নেয়ার শুরুতেই ভূরাজনীতিক পরিস্থিতি সে প্রতিশ্রুতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। স্তেফান সেজর্নের ‘সবচেয়ে বড় আশঙ্কা’ যে ইউরোপ ‘বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধে বলির পাঁঠা’ হবে কিনা।
তিনি বলেন, ‘যদি বৈশ্বিক সব বাজার বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে ইউরোপ একমাত্র উন্মুক্ত বাজার হতে পারে না। যদি লাতিন আমেরিকা, ভারত ও চীনকে অবরুদ্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র, তবে ইউরোপীয় বাজার সব অতিরিক্ত উৎপাদনের গন্তব্য হতে পারে না। এমন হলে আমরা স্বল্পমেয়াদি অর্থনৈতিক সংকটে চলে যাব।’
ইইউ শিল্প ও প্রযুক্তিবিষয়ক প্রধানের মতে, যুক্তরাষ্ট্রকে শক্তিশালী বার্তা পাঠাতে হবে। ব্রাসেলস সেখানে জানাবে, ইউরোপের বাণিজ্য আলোচনা এবং বিনিময়কে অবমূল্যায়ন করার কোনো সুযোগই নেই। মার্কিন নতুন প্রশাসনকে বুঝতে হবে বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাদেরও লাভ হবে না।
প্রতিপক্ষের সুরক্ষাবাদী নীতির মতোই একই এজেন্ডা নিয়ে ইউরোপ হাঁটছে কিনা, সে সমালোচনা এড়িয়ে গেছেন স্তেফান সেজর্নে। তিনি বলেন, ‘এটি মোটেও সুরক্ষাবাদী আচরণ নয়। কারণ বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধে কোনো আগ্রহ নেই ইউরোপের। আমাদের নিজস্ব শিল্প তৈরি, নতুন কর্মসংস্থান এবং প্রবৃদ্ধি অর্জনে কৌশলগত ও প্রযুক্তিগত আগ্রহ রয়েছে।’
কভিড-১৯-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতিগুলো অনেকটাই এগিয়ে গেলেও ইউরোপ তুলনামূলক মন্থর প্রবৃদ্ধিতে রয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক গাড়ি নির্মাণ ও ইস্পাত শিল্পে ছাঁটাই অর্থনীতিতে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে। একই সঙ্গে সুইডিশ বৈদ্যুতিক ব্যাটারি প্রস্তুতকারক নর্থভোল্টের পতন নতুন প্রযুক্তি বিকাশে ছেদ হিসেবে ধরা হচ্ছে। অথচ ওই কারখানাকে মহাদেশটির জ্বালানি খাতে পরিবেশবান্ধব রূপান্তরের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হতো।
ইউরোপীয় অর্থনীতির নেতিবাচক এ ধারা স্বীকার করে স্তেফান সেজর্নে প্রতিশ্রুতি দেন ইস্পাত, গাড়ি নির্মাণ ও মহাকাশ শিল্পের মতো কৌশলগত খাতের পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির বিকাশে কাজ করবে কমিশন। তিনি বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত খাত লক্ষ্যভিত্তিক করা প্রয়োজন। তবে প্রতিরক্ষা নয়, আপনাকে আক্রমণাত্মকভাবে হতে হবে।’
ইউরোপের ‘ঐতিহাসিক’ শিল্পগুলো রক্ষা করা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন স্তেফান সেজর্নে। কারণ এগুলো প্রযুক্তির সবুজ রূপান্তরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি বলেন, ‘এখন বাস্তবতা হলো কৌশলগত পদক্ষেপের। কারণ ইস্পাত ছাড়া উইন্ড টারবাইন বা গাড়ি উৎপাদন সম্ভব নয়। অতএব, যদি আমরা অন্যান্য শিল্পে বিকাশ করতে চাই, তাহলে ইস্পাত শিল্পের প্রয়োজন রয়েছে।’
এছাড়া হাইড্রোজেন ও ডিজিটাল প্রযুক্তি ‘সবচেয়ে বেশি দূষিত শিল্পগুলোয় ইনস্টল করা যেতে পারে’, যাতে এসব প্রকল্প থেকে নিঃসরণ কমানো যায় বলেও মন্তব্য করেন স্তেফান সেজর্নে।
নতুন এ কমিশন ডিসেম্বরের প্রথম দিন থেকে কাজ করছে। প্রথম ১০০ দিনে তারা গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো চিহ্নিত করবে। আরেকটি প্রধান লক্ষ্য হলো ব্লকের পুঁজিবাজারগুলো একত্রিত করা, যাতে একটি ভালো বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়। এ দীর্ঘকালীন লক্ষ্য ইইউর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আপত্তির কারণে ব্যাহত হয়ে আসছে।
স্তেফান সেজর্নে বলেন, ‘আমরা একটি ইউরোপীয় শিল্প ও একটি অর্থনৈতিক নীতি গড়ে তুলতে আগ্রহী, যা এখনো হয়ে ওঠেনি। আমাদের এখন পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যবস্থার সংমিশ্রণ ছিল, যা কখনো কখনো পরস্পরের সঙ্গে সুসংগত ছিল না।’
গত সপ্তাহে দেউলিয়াত্বের আবেদন করেছে নর্থভোল্ট। ইউরোপের সবচেয়ে সংঘটিত অর্থায়নের এ স্টার্টআপের পতন ব্রাসেলসের বিদ্যমান শিল্প কৌশলের জন্য বড় একটি আঘাত। ফলে গোল্ডম্যান স্যাকস ও ইইউসহ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হয়েছে। তারা কোম্পানিকে প্রায় ৩০ কোটি ইউরো ঋণ দিয়েছিল। স্তেফান সেজর্নে বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে চান ব্যাটারি শিল্পকে ত্যাগ করবে না ইউরোপ। খাতটি পুনরুদ্ধারে তারা কাজ করবে।
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন