নিরাপদ, দ্রুততর আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সিকে (সিবিডিসি) সম্ভাবনাময় মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি মূলত কোনো দেশের মুদ্রার ডিজিটাল সংস্করণ, যা ওই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইস্যু করে। তবে বৈশ্বিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সমন্বিত নেটওয়ার্ক গড়ে না ওঠা ও মুদ্রা ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর আশঙ্কায় সিবিডিসির জনপ্রিয়তা কমছে। স্বয়ং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও এ নিয়ে আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছে। সম্প্রতি ওএমএফআইএফর ডিজিটাল মনিটারি ইনস্টিটিউটের (ডিএমআই) বার্ষিক সেন্ট্রাল ব্যাংকার জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
জরিপের ফলে দেখা যায়, মাত্র ১৩ শতাংশ উত্তরদাতা সিবিডিসিকে আন্তর্জাতিক লেনদেনের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সমাধান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যা গত বছরের তুলনায় ৩১ শতাংশ কম। সিবিডিসি নিয়ে আশান্বিত না হওয়ার তালিকায় একাডেমিক থেকে শুরু নীতিনির্ধারক ও সমালোচকরা আছেন। গত এক বছরে সিবিডিসি নিয়ে কাজ করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। গত বছর ২১ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিনিময়ের মাধ্যমটি নিয়ে করছিল। চলতি বছর এ সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মালিকানাধীন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটলমেন্টস (বিআইএস) ‘আগোরা’ নামে একটি সিবিডিসি-ভিত্তিক পেমেন্ট সিস্টেম চালুর ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পিপলস ব্যাংকের একই ধরনের প্রকল্প ‘এমব্রিজে’রও অগ্রগতি হয়েছে। তা সত্ত্বেও সিবিডিসি নিয়ে কাজ করা ব্যাংকের সংখ্যা কমেছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, আগোরা ও এমব্রিজের অগ্রগতিও এর পেছনে দায়ী হতে পারে। কেননা এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণসংশ্লিষ্ট ও প্রযুক্তিগত জটিলতার সঙ্গে বিদ্যমান পেমেন্ট সিস্টেমের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার বিষয়টি সামনে আসবে।
প্রযুক্তির বিকাশের কারণে বৈশ্বিক লেনদেন ব্যবস্থায় আলিবাবা, গুগল বা মেটার মতো টেক জায়ান্টগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এছাড়া টোকেনাইজেশন বা স্থাবর সম্পদ ডিজিটাল মুদ্রায় রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল মুদ্রার অতিরিক্ত মজুদ গড়ে তুলতে পারে। এতে নিজস্ব মুদ্রার ওপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষুণ্ন হতে পারে দেশগুলোর। তাই আর্থিক স্বাধীনতার বিষয়টি অক্ষুণ্ন রাখার লক্ষ্যে সিবিডিসি চালু করা হয়। শুরুর দিকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল, বিশ্বব্যাপী বহুমুদ্রাভিত্তিক একটি সিবিডিসি বিনিময় পদ্ধতি তৈরি করা হবে, যেখানে লাইসেন্সধারী ডিলাররা নিজেদের মধ্যে লেনদেন করতে পারবে। তবে এরই মধ্যে দুটি নির্দিষ্ট কোম্পানির প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে এটি।
গত মাসে বিআইএস চীনা এমব্রিজ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সরে এসেছে। সম্প্রতি নিজস্ব পেমেন্ট প্রজেক্ট আগোরা চালু করেছে তারা। সাতটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো থেকে ব্যাংক অব মেক্সিকোও আছে।
ডিএমআইয়ের প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে এমব্রিজ বা এর পরে আসা পেমেন্ট সিস্টেমগুলো উদীয়মান অর্থনীতির জন্য একটি প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে বলে উল্লেখ করা হয়। এদিকে পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্লাটফর্ম হতে পারে আগোরা, যারা মার্কিন ডলারের আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। প্রতিবেদনে রাশিয়ার ব্রিকস পেমেন্ট নেটওয়ার্ক তৈরির প্রচেষ্টাও সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব সমান্তরাল নেটওয়ার্ক একসঙ্গে ভালোভাবে কাজ করবে না বলে মনে হচ্ছে। এর পরিবর্তে তারা একটি ‘হাব-এন্ড-স্পোক’ মডেলের কথা বলছেন, যেখানে প্রতিটি দেশের সিবিডিসি নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী চলবে, কিন্তু একটি কেন্দ্রীয় কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত থাকবে। পদ্ধতিটি অন্য যেকোনো বিকল্পের চেয়ে বেশি বাস্তবসম্মত বলে মত তাদের। তবে এটি তৈরির কাজ এখনো প্রাথমিক পর্যায়েই আছে।
মার্কিন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ব্যারি আইচেনগ্রিন বলেন, ‘আন্তঃসীমান্ত লেনদেন কার্যকর করতে একাধিক সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একমত হতে হবে, কারা সিবিডিসি ডিলার হিসেবে অনুমোদিত হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে লেনদেন পর্যবেক্ষণ এবং ডিলারদের সিবিডিসি মজুদ পর্যাপ্ত কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে তারল্য সরবরাহকারী হিসেবে প্রস্তুত থাকতে হবে। এ সবকিছু বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ব্যাসেল কমিটি অন ব্যাংকিং সুপারভিশনের চেয়েও শক্তিশালী একটি কাঠামো।’
সিবিডিসি নিয়ে আশাবাদ কমলেও সুইফটসহ বিদ্যমান অবকাঠামো হালনাগাদ করার কথা বলেন জরিপে অংশগ্রহণকারীরা। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক ব্যাংকার তাৎক্ষণিক পেমেন্ট সিস্টেম উন্নত করাকে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় পথ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তবে এক্ষেত্রেও ধীরগতি দেখা যাচ্ছে।
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন