ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ায় তীব্র হচ্ছে শ্রম সংকট – The Finance BD
 ঢাকা     মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:২৫ পূর্বাহ্ন

ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ায় তীব্র হচ্ছে শ্রম সংকট

  • ৩০/১১/২০২৪

সম্প্রতি রাশিয়ার ইউরাল পর্বতমালার সভার্দলোভস্ক অঞ্চলের বাসিন্দা ওলগা স্লাতিনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, ‘আজ সকালে বাস নম্বর সাত চলেনি’। সম্প্রতি রাশিয়ার ইউরাল পর্বতমালার সভার্দলোভস্ক অঞ্চলের বাসিন্দা ওলগা স্লাতিনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, ‘আজ সকালে বাস নম্বর সাত চলেনি’। কারণ হিসেবে তিনি জানান, সেদিন বাস চালানোর মতো কেউ ছিলেন না।
ঘটনাটি উল্লেখ করে রয়টার্স এক প্রতিবেদনে বলছে, কামেনস্ক-উরালস্কি শহরের ওই বাসচালক হয়তো অসুস্থ ছিলেন, তাই গাড়ির চাকা সেদিন থেমেছিল। কিন্তু রাশিয়ার শ্রম সংকট বর্তমানে এমন এক স্তরে পৌঁছেছে যে এটি সব ধরনের উৎপাদন ও পরিষেবা খাতে প্রভাব ফেলছে। কোম্পানি, শ্রমিক, নিয়োগ সংস্থা ও কর্মকর্তারা বলছেন, এ সংকট ক্রমেই বাড়ছে। বিদেশী কর্মীর মাধ্যমে সংকট কাটানোর উপায়ও আপাতত সামনে নেই।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে পূর্ণদ্যোমে হামলা শুরু করে রাশিয়া। ওই সময় থেকে কিয়েভকে নানাভাবে সাহায্য করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো। এর সূত্রে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় রুশ সামরিক বাহিনী ও প্রতিরক্ষা খাতে ব্যাপক কর্মশক্তি প্রয়োজন হচ্ছে। এর বিপরীতে অন্যান্য খাত ভুগছে কর্মী সংকটে। কর্মী সংকটের আরেকটি কারণ যুদ্ধ ও সেনাবাহিনীতে যোগদান এড়াতে ব্যাপকসংখ্যক মানুষের দেশত্যাগ। ফলে রাশিয়ার বেকারত্বের হার কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৩ শতাংশে, যা দেশটির পরিসংখ্যান অফিস রোসস্ট্যাটের তথ্যানুযায়ী রেকর্ড সর্বনিম্ন।
ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর একের এক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিয়ে আসছে, যা দেশটির অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। সেখানে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে ফুলেফেঁপে ওঠা সামরিক খাত। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, প্রতিরক্ষা খাতে ব্যাপক ব্যয় বৃদ্ধি এবং সামরিক শিল্পের প্রসারে রাশিয়া ২০২২ সালে অর্থনৈতিক ধস থেকে রক্ষা পায়। অবশ্য এ বছর অর্থনীতি সামান্য সংকুচিত হয়েছিল। ২০২৩ সালে অর্থনীতি কিছুটা পুনরুদ্ধার করলেও পরবর্তী সময়ে ২১ শতাংশ পর্যন্ত উচ্চ সুদহার, মুদ্রাস্ফীতি ও শ্রম সংকট এ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করছে।
রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন শ্রম সংকটকে তার দেশের অর্থনীতির জন্য ‘বড় সমস্যা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং রাশিয়ার শ্রম উৎপাদনশীলতা বাড়ানোকে তার অন্যতম প্রধান উন্নয়ন লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করেছেন। একই সঙ্গে রুশ নারীদের আরো বেশি সন্তান নিতে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে।
শ্রম সংকট সবচেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে সভার্দলোভস্ক এলাকায়। এখানে প্রতিরক্ষা খাতের অনেক কারখানা রয়েছে। অক্টোবরের শুরুতে এ অঞ্চলে ৫৪ হাজার ৯১২টি শূন্যপদ ছিল, অথচ বেকারের সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৭৬২। রাশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় সেন্ট্রাল ফেডারেল ডিস্ট্রিক্টে চার কোটি মানুষের বাস। সেখানে একজন বেকারের বিপরীতে নয়টি চাকরির সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত ইগর শেচেগোলেভ
নিয়োগ সংস্থা সুপারজব জানিয়েছে, রাশিয়াজুড়ে শূন্যপদ দুই বছরে ১ দশমিক ৭ গুণ বেড়েছে এবং শিল্প খাতে বৃদ্ধির এ হার আড়াই গুণ। রাশিয়ার একাধিক খাতেই এ সংকটের প্রভাব স্পষ্ট। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সভার্দলোভস্ক অঞ্চলের প্রতিরক্ষা খাতের কারখানাগুলোয় উৎপাদন ব্যাপক বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে প্রচুর কর্মী প্রয়োজন। কেউ কেউ এখন ড্রোন তৈরির মতো উচ্চ বেতনের কাজে যোগ দিচ্ছেন। তাতারস্তানের আলাবুগায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ড্রোন তৈরিতে কর্মীরা দিনরাত কাজ করছেন। একজন কর্মী জানিয়েছেন, তারা এত ব্যস্ত যে উপার্জিত অর্থ খরচ করার সময়ও পাচ্ছে না।
সভার্দলোভস্ক অঞ্চলে যারা সামরিক বাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন, তারা এককালীন ২১ লাখ রুবল বা ১৮ হাজার ৫৬০ ডলার সাইনিং বোনাস পাচ্ছেন, যা রাশিয়ার গড় মাসিক বেতনের প্রায় ২৫ গুণ। প্রতিরক্ষা শিল্পের উচ্চ বেতন ও সীমাহীন বাজেটের কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে বেসামরিক খাত। নির্মাণ খাতে শ্রম সংকট এতটাই তীব্র যে কিছু কোম্পানি নতুন প্রকল্প নেয়া থেকে বিরত থাকছে।
২০২৩ সালে কৃষি খাত থেকে প্রায় দুই লাখ কর্মী অন্য পেশায় চলে গেছেন, যা মোট কর্মশক্তির ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। ফলে চাষাবাদ ও ফসল কাটার কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষি ছাড়াও রুশ পুলিশ বিভাগে কর্মী সংকট দেখা দিয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, এ বিভাগে খালি পদ গত দুই বছরে দ্বিগুণ হয়ে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৮০০-এ পৌঁছেছে, যা মোট কর্মীর ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ।
ইউক্রেন যুদ্ধজনিত বিধিনিষেধে বহিরাগত শ্রমিক প্রাপ্তিতেও সমস্যা দেখা যাচ্ছে। রাশিয়ার ব্যবসায়িক লবিং গ্রুপ আরএসপিপি জানিয়েছে, দুই-তৃতীয়াংশ কোম্পানি অভিবাসী শ্রমিক আকর্ষণে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। ভিটিবি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী আন্দ্রে কোস্টিন বলেছেন, ‘অভিবাসী ছাড়া রুশ অর্থনীতি এগোতে পারবে না।’
বিভিন্ন খাতে শ্রম সংকটের এ ঊর্ধ্বগতি রাশিয়ার ভবিষ্যৎ অর্থনীতির জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, শ্রম সংকটের কারণে রাশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরো শ্লথ হবে। চলতি বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৯ শতাংশ প্রত্যাশিত হলেও আগামী বছর তা আড়াই শতাংশে নেমে যেতে পারে। গত জুনে রাশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি চেরনিশেঙ্কো বলেছেন, ‘আমরা এখনো বুঝতে পারছি না, কোথা থেকে অতিরিক্ত কর্মী পাব। আমরা সবাই এখন বিশ্বাস করি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই আমাদের বাঁচাবে। কারণ অন্য কোনো বিকল্প নেই।’

ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

Leave a Reply




Contact Us