মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক যেকোনো উত্তেজনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া হয় খুবই দ্রুত। এ অঞ্চলে দেশটির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ বহুলচর্চিত এবং প্রায় সবারই জানা। মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক যেকোনো উত্তেজনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া হয় খুবই দ্রুত। এ অঞ্চলে দেশটির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ বহুলচর্চিত এবং প্রায় সবারই জানা। বিশেষ করে ইসরায়েলের সঙ্গে মার্কিন স্বার্থের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফেডারেল রিজার্ভের সাম্প্রতিক এক জরিপে বিষয়টি উঠে এসেছে। সেখান থেকে জানা যাচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে বাড়তে থাকা উত্তেজনা নিকটমেয়াদে মার্কিন আর্থিক ব্যবস্থার জন্য মূল্যস্ফীতি ও উচ্চ সুদহারের তুলনায় বেশি ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
ফেডের ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট বা আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ৪৬ শতাংশ উত্তরদাতা মার্কিন আর্থিক ব্যবস্থার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনাকে উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এর বিপরীতে মূল্যস্ফীতি ও নীতিগত কড়াকড়িকে ঝুঁকি হিসেবে দেখেছেন ৩৩ শতাংশ জরিপ অংশগ্রহণকারী।
বছরে দুবার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে ফেড, এতে মার্কিন আর্থিক ব্যবস্থার মূল্যায়ন করা হয়। এবারের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনাকে ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করছেন এমন উত্তরদাতা গতবারের তুলনায় ১৪ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতিকে ঝুঁকি হিসেবে দেখার হার ৭২ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৩৩ শতাংশে।
অবশ্য আর্থিক ব্যবস্থার জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে দেখা হচ্ছে ক্রমে বেড়ে চলা সরকারি ঋণকে। জরিপে ৫৪ শতাংশ উত্তরদাতা জানান, নিকটমেয়াদে সরকারি ঋণের স্থায়িত্বকে ঝুঁকি হিসেবে দেখেছেন তারা।
গত বছরের অক্টোবরে ইসরায়েলি সীমান্ত পেরিয়ে আক্রমণ করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস। এতে প্রায় ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত ও দুই শতাধিককে জিম্মি করা হয়। এরপর ইসরায়েলি সর্বাত্মক হামলায় এক বছরের বেশি সময় গাজায় কমপক্ষে ৪৪ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এ যুদ্ধে ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সাম্প্রতিক সময়ে এটি লেবাননে ছড়িয়ে পড়েছে। ইরানের সঙ্গে উত্তেজনা ও পাল্টাপাল্টি হামলা তো রয়েছেই। এছাড়া হুথি বিদ্রোহীদের হামলার কারণে বন্ধ রয়েছে লোহিত সাগরের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ।
ফেডের প্রতিবেদনে উত্তরদাতারা আশঙ্কা প্রকাশ করে জানান, মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনার তাৎক্ষণিক ঝুঁকি হলো এ সংঘাত অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কেউ কেউ সতর্ক করেছেন যে এটি একটি বৈশ্বিক সংঘাতে পরিণত হতে পারে। জ্বালানি সরবরাহ ও বৃহত্তর পণ্যবাজারে ব্যাঘাতের মাধ্যমে এ উত্তেজনা আর্থিক স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলে বলে উত্তরদাতারা উল্লেখ করেছেন।
ইউক্রেন যুদ্ধ ও গত বছর মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ার পর থেকে ফেডারেল ওপেন মার্কেট কমিটির বৈঠকে ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হয়ে আসছে, যা ফেড প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার আরো বৃদ্ধি অর্থনৈতিক কার্যকলাপ হ্রাস, মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি ও বৈশ্বিক আর্থিক বাজারে অস্থিরতা বাড়াতে পারে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে উচ্চ সম্পদমূল্য এবং বাড়তে থাকা ভূরাজনৈতিক ও নীতিগত অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের হঠাৎ ঝুঁকি এড়ানোর দিকে নিয়ে যেতে পারে। এতে সম্পদের মূল্য হ্রাস পেতে পারে, যা মার্কিন ব্যবসা ও বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।
ফেড চেয়ার জেরোম পাওয়েল ভূরাজনৈতিক ঝুঁকিকে সম্ভাব্য ‘কালো মেঘ’ হিসেবে উল্লেখ করে জানান, এ সংঘাতগুলো এখন পর্যন্ত অর্থনীতিতে বড় কোনো প্রভাব ফেলেনি। তবে এটি জ্বালানি তেলের দামের মতো বিষয়ের ওপর নির্ভর করে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
জ্বালানি তেলের দাম বছরের শুরুতে বাড়ার পর আপাতত স্থিতিশীল। গত শুক্রবার ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ৭১ ডলার ২০ সেন্ট ও ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের ছিল ৭১ ডলার ১৬ সেন্ট।
অবশ্য বর্তমানে মার্কিন অর্থনীতি মজবুত রয়েছে। শক্তিশালী ভোক্তাব্যয়ের ওপর নির্ভর করে বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশটির অর্থনীতির ২ দশমিক ৮ শতাংশ সম্প্রসারণ হয়েছে। একই সময় বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ১ শতাংশ ও মূল্যস্ফীতি ফেডের ২ শতাংশ লক্ষ্যের কাছাকাছি নেমে এসেছে। এ ইতিবাচক পরিস্থিতি অর্থনীতির জন্য ‘সফট ল্যান্ডিং’-এর আবহ তৈরির সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তুলেছে। সেপ্টেম্বর থেকে দুই দফায় মোট ৭৫ বেসিস পয়েন্টে সুদহার কমানোর পর ফেড আগামী ডিসেম্বরে সিদ্ধান্ত নেবে যে নীতিমালা আরো শিথিল করা প্রয়োজন কিনা।
মার্কিন অর্থনীতিতে টানা কয়েক প্রান্তিক সুদহার ও মূল্যস্ফীতির টানাপড়েন সব ধরনের মনোযোগ ধরে রেখেছিল। তবে নতুন জরিপে মূল্যস্ফীতি বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখা গেছে। আগের প্রতিবেদনের তুলনায় মূল্যস্ফীতি ও নীতিমালার কড়াকড়িকে ঝুঁকি হিসেবে দেখার হার কমেছে ৫৯ শতাংশ। একই সময় ৩৮ শতাংশ উত্তরদাতা মন্দাকে এখনো একটি ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এ দৃষ্টি কিছুটা অনিশ্চয়তা নির্দেশ করে।
বৈশ্বিক বাণিজ্য যুদ্ধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন উত্তরদাতারা। তাদের মতে, শুল্ক প্রতিবন্ধকতা পাল্টা প্রতিরক্ষামূলক নীতিকে প্ররোচিত করতে পারে। এটি বৈশ্বিক বাণিজ্যপ্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ও মূল্যস্ফীতির ওপর নতুন চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এ উদ্বেগগুলো ট্রেজারি বাজারেও প্রতিফলিত হয়েছে, যেখানে ফেডের সুদহার কমানোর পরও ১০ বছর মেয়াদি বন্ডের ইল্ড বেড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদের মূল্যচাপ এখনো বেশি রয়ে গেছে, তবে গৃহস্থালি ও ব্যবসায়িক ঋণের ঝুঁকি কমে গেছে। তবুও ক্রেডিট কার্ড ও অটো লোনে খেলাপির হার কভিড মহামারীর আগের মাত্রার ওপরে রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে ফেড। এছাড়া ব্যাংক খাত স্থিতিশীল রয়েছে এবং কিছুটা কমলেও এখনো ‘উল্লেখযোগ্য’ পরিমাণ তহবিল ঝুঁকি রয়ে গেছে। (খবরঃ দ্য ন্যাশনাল)
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন