মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের পর আবারো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য সম্পর্ক। ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য সংঘাত অবশ্যম্ভাবীভাবে উভয় পক্ষের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবে। তা সত্ত্বেও গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের একটি প্যানেল চীনের সঙ্গে বাণিজ্য নীতিকে কঠোর করার সুপারিশ করেছে। তবে কিছুটা নমনীয় অবস্থান দেখা গেছে চীনের তরফে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য বিষয়ে ‘ইতিবাচক সংলাপে’ অংশ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে দেশটি। গত শুক্রবার চীনের উচ্চ পদস্থ কয়েকজন বাণিজ্য কর্মকর্তা এ মন্তব্য করেন।
কর্মকর্তারা (মার্কিন) সুরক্ষাবাদী নীতির বিরুদ্ধে বেইজিংয়ের অটল অবস্থানের কথা জানান। ট্রাম্প চীন থেকে আমদানীকৃত পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ শুল্কারোপের কথা বলেছেন। এটি বাস্তবায়ন হলে আন্তর্জাতিক বাজারে ডলার আরো শক্তিশালী হবে। এ অবস্থায় চীনা পণ্য আরো বেশি ব্যয়ববহুল হয়ে উঠতে পারে। তাই মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও নেয়া হবে বলে জানান কর্মকর্তারা। এর আগে রফতানিকারকদের শক্তিশালী করার জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপও ঘোষণা করেছে চীন।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রতিনিধি ও উপমন্ত্রী ওয়াং শৌয়েন বলেন, ‘চীন ও যুক্তরাষ্ট্র শক্তিশালী অর্থনৈতিক পরিপূরকতার অংশীদার। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইতিবাচক সংলাপে অংশ নিতে আগ্রহী। তবে চীন”একই সঙ্গে নিজের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন রক্ষায় অটল থাকবে।’
আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে দায়িত্বভার বুঝে নেবে ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন। একে সামনে রেখে গত বৃহস্পতিবার রফতানিকারকদের সহায়তার জন্য নীতিমালা ঘোষণা করেছে চীন। ট্রাম্পের প্রাথমিক মন্ত্রিসভার নিয়োগে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বিষয়ে কড়া অবস্থান নেয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে বলে মনে করছে চীনা কর্তৃপক্ষ।
এদিকে রফতানি শক্তিশালীকরণের অংশ হিসেবে চীনা ব্যাংকগুলোকে রফতানি খাতে আরো বেশি ঋণ প্রদান ও বৈদেশিক মুদ্রার বিপর্যয় মোকাবেলায় কোম্পানিগুলোকে সহায়তা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ই-কমার্স সম্প্রসারণ ও কৃষিপণ্যের রফতানি বাড়াতে সহায়তার কথা জানিয়েছে চীন। পাশাপাশি”অযৌক্তিক বৈদেশিক বাণিজ্য বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাতে কোম্পানিগুলোকে সাহায্য করবে কর্তৃপক্ষ। এসব পদক্ষেপের অংশ হিসেবে চীন ব্যবসায়ীদের জন্য সীমান্ত পারাপারের প্রক্রিয়া সহজ করতে এবং ভিসামুক্ত ভ্রমণের ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ব্যবসায়িক যোগাযোগ উৎসাহিত করবে।
অর্থনীতি শক্তিশালী করতে চীনকে উৎপাদন বিনিয়োগ ও রফতানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। কেননা আবাসন খাতে দীর্ঘস্থায়ী মন্দার কারণে দেশটির অভ্যন্তরীণ চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে গেছে।
অক্টোবরে চীনের বার্ষিক রফতানি ডলারে হিসাব করলে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ায় বাণিজ্য উত্তেজনাও সমান হারে বেড়েছে।
ইইউ অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়াতে যথেষ্ট পদক্ষেপ না নেয়া এবং নিজস্ব বাজারে বিদেশী কোম্পানিগুলোর জন্য বাধা দূর করতে চীনের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ এনেছে। অক্টোবরে চীনের আমদানি বার্ষিক ২ দশমিক ৩ শতাংশ কমে গেছে।
উপমন্ত্রী ওয়াং শৌয়েন বলেন, ‘চীনা অর্থনীতি এরই মধ্যে চমৎকার স্থিতিস্থাপকতা প্রদর্শন করেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত শুল্ক মূলত মার্কিন ভোক্তাদের ওপর প্রভাব ফেলেছে।’
কিছু অর্থনীতিবিদ মনে করছেন, ট্রাম্পের শুল্ক নীতির প্রতিক্রিয়ায় চীন রেনমিনবির অবমূল্যায়ন করতে পারে, যা বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনের ক্ষেত্রে চীনা পণ্যকে আরো প্রতিযোগিতামূলক করবে।
তবে চীনের পিপলস ব্যাংকের আন্তর্জাতিক বিভাগের পরিচালক লিউ ইয়ি বলেছেন, ‘রৈনমিনবির বিনিময় হার একটি যুক্তিসংগত ও ভারসাম্যপূর্ণ স্তরে স্থিতিশীল থাকার বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিশ্চিত করবে।’
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংও স্থিতিশীল বিনিময় হার বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ বিশ্বের বৃহত্তম রফতানিকারক ও উৎপাদক দেশটি নিজেকে একটি নির্ভরযোগ্য বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়।
এদিকে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রধান অর্থনীতিবিদ ইউয়ে সু বলেন, ‘ট্রাম্প আগামী বছরের প্রথমার্ধে চীনের ওপর শুল্ক আরোপ করতে পারেন। তিনি আন্তর্জাতিক জরুরি অর্থনৈতিক ক্ষমতা আইন বা ১৯৭৪ সালের ট্রেড অ্যাক্টের সেকশন ১২২ ব্যবহার করে এ প্রক্রিয়া দ্রুততর করতে পারেন। এ আইন প্রেসিডেন্টকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করার অনুমতি দেয়।’
তবে অন্যান্য বিশ্লেষক চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন শুল্ক বৃদ্ধির বিষয়ে কম উদ্বিগ্ন। ইনভেসকোর এশিয়া প্যাসিফিক গ্লোবাল মার্কেট স্ট্র্যাটেজিস্ট ডেভিড চাও বলেন, ‘ট্রাম্পের শুল্ক প্রস্তাব সম্ভবত চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে বাস্তবায়ন হতে পারে। নতুন প্রশাসন এ শুল্ক আরোপ বিলম্বিত করতে পারে, যাতে আরো বেশি আমেরিকান সয়াবিন বিক্রি কিংবা ভূরাজনৈতিক সুবিধা আদায় করা যায়।
‘যুক্তরাষ্ট্রে সব ধরনের রফতানির ওপর সম্ভাব্য ১০ শতাংশ শুল্ক বিশ্বব্যাপী চাহিদাকে দুর্বল করতে পারে। এটি চীন ও এশিয়ার বাকি দেশগুলোর ওপর বড় প্রভাব ফেলবে।’
খবর : ফ্যাইন্যান্সিয়াল টাইমস ও এপি।
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন