যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় বৈশ্বিক অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে অন্যান্য মুদ্রার তুলনায় ডলারের শক্তিশালী অবস্থান বাজারের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এ প্রবণতায় এক বছরের বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় নেমে এসেছে ইউরো। অর্থাৎ, ইউরোপের প্রধান অর্থনীতিগুলোর এ একক মুদ্রার ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমেছে। এর বিপরীত দিকও রয়েছে। কারণ শক্তিশালী ডলারের সুবাদে বেশকিছু ইউরোপীয় কোম্পানি লাভবান হতে পারে।
ইউরো নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় ও কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণ সম্ভাব্য নীতিগত পরিবর্তনের পথ খুলে দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিদেশী পণ্য আমদানির ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ, প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি এবং বিদেশী সাহায্যের পুনর্মূল্যায়ন। এ পরিবর্তনগুলো বৈশ্বিক আর্থিক বাজারে প্রভাব ফেলছে এবং ডলার শক্তিশালী হয়ে উঠছে। কারণ বিনিয়োগকারীরা এ পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছেন।
এ পরিস্থিতিতে শক্তিশালী ডলারের কারণে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর জন্য নতুন সুবিধা তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানি বা ডলারনির্ভর বাজারে কাজ করে, এমন কোম্পানির ভাগ্য খুলে যেতে পারে। ডলার শক্তিশালী হওয়ায় তাদের পণ্য মার্কিন গ্রাহকের কাছে সস্তা হয়ে যাবে, যা প্রতিযোগিতা বাড়ানোর পাশাপাশি বিক্রি ও মুনাফা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।
এফটির এক প্রতিবেদন অনুসারে, ইউরো এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিম্নস্তরে চলে গেছে। ১ ডলারের বিনিময়ে পাওয়া যাচ্ছে প্রায় ১ দশমিক শূন্য ৫ ইউরো, যা ২০২২ সালের জ্বালানি সংকটের পর সবচেয়ে তীব্র পতন।
সম্প্রতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক অব আমেরিকা এমন কিছু ইউরোপীয় কোম্পানি চিহ্নিত করেছে, যারা এ পরিস্থিতির সুবিধা নিতে পারে। এক্ষেত্রে তারা দুটি সুবিধা পেতে পারে। প্রথমত, ডলারে আয়ের মাধ্যমে কোম্পানিগুলো ইউরোর পতনের প্রভাব থেকে তুলনামূলক সুরক্ষিত থাকবে। দ্বিতীয়ত, ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতি পরিবর্তনজনিত অনিশ্চয়তা থেকে কোম্পানিগুলো রক্ষা পেতে পারে। কারণ দ্বিতীয় দফায় হোয়াইট হাউজে এসে তিনি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কতটা আগ্রাসীভাব বজায় রাখবেন তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। বিশেষ করে বাণিজ্য সুরক্ষা নীতির ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসায়ীরা চিন্তিত। তবে ডলারের শক্তিশালী অবস্থান ব্যবহার করে কিছু কোম্পানি সহজে এ ঝুঁকি সামলে নিতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব ইউরোপীয় কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাদের আয়ের একটি বড় অংশ অর্জন করে তারা লাভবান হবে। তবে এতে বাড়তি সুবিধা দিতে পারে উত্তর আমেরিকায় স্থাবর সম্পত্তির অনুপস্থিতি। আয়-সম্পদ ভারসাম্যের কারণে এসব কোম্পানি উত্তর আমেরিকার বিক্রি থেকে মুনাফা বাড়াতে পারে, একই সময়ে ডলারভিত্তিক সম্পদের খরচ বাড়ার ঝুঁকি কম থাকবে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে অর্জিত ডলার ইউরোয় রূপান্তর তাদের জন্য লাভজনক থাকবে। এটি তাদের আয়ে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। কেননা মূল্য বা উৎপাদন স্তর পরিবর্তন করা ছাড়াই এ সুবিধা পাবে কোম্পানিগুলো।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে কম স্থাবর সম্পদ থাকা কোম্পানি ডলারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিচালন খরচের ঝুঁকি কমাতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রে যেসব কোম্পানির ন্যূনতম পর্যায়ে কার্যক্রম রয়েছে, তারা উচ্চ আয়ের সুবিধা নিতে পারবে। কিন্তু রিয়েল এস্টেট, বেতন বা নিয়ন্ত্রক খরচের চাপের মধ্যে পড়ে এমন বিনিয়োগ মুনাফা কমিয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রে উল্লেখযোগ্য সম্পদ থাকা কোম্পানিগুলো ডলারভিত্তিক খরচের প্রতি বেশি সংবেদনশীল হবে।
ব্যাংক অব আমেরিকার প্রতিবেদন অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে কম সম্পদ ইউরোপীয় কোম্পানিকে শক্তিশালী ডলার ও দুর্বল ইউরোর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সাহায্য করতে পারে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির বিশ্লেষক পলিনা স্ট্রজেলিনস্কা বাজার হিস্যা ও সম্পদের ওপর ভিত্তি করে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর একটি গ্রুপ চিহ্নিত করেছেন, যারা ডলার শক্তিশালী হওয়ার ফলে লাভবান হতে পারে।
তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে ডেনিশ ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি নভো নরডিস্ক। এ প্রতিষ্ঠানের আয়ের ৫৯ শতাংশেরই উৎস উত্তর আমেরিকা, বিপরীতে সেখানে কোম্পানির কোনো স্থাবর সম্পদ নেই। এতে ডলারভিত্তিক পরিচালন খরচ থেকে সুরক্ষিত থাকবে স্থূলতা প্রতিরোধী ওষুধের জন্য বিখ্যাত নভো নরডিস্ক এবং কারেন্সি রূপান্তরের লাভ থেকে উপকৃত হবে।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর (বিএটি) পণ্যের ৪৪ শতাংশ বিক্রি হয় উত্তর আমেরিকায়। এখানে তাদের কোনো স্থাবর সম্পদ নেই, যা ডলারভিত্তিক খরচের ছাড় থেকে মুক্তি দেয় কোম্পানটিকে। স্পেনের অবকাঠামো কোম্পানি ফেরোভিয়ালের ৩৬ শতাংশ আয় হয় উত্তর আমেরিকার বাজারে এবং এখানে কোম্পানির কোনো স্থাবর সম্পদ নেই।
নিভিয়াসহ অনেক পরিচিত ব্র্যান্ডের মালিকানা রয়েছে জার্মান কোম্পানি বেইয়ারসডর্ফের অধীনে। বৈশ্বিক এ কোম্পানি আয়ের ২৬ শতাংশের জন্য উত্তর আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল। এ কোম্পানিরও কোনো স্থাবর সম্পদ নেই যুক্তরাষ্ট্রে। এরপর পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে নরওয়ের প্রতিরক্ষা ও সামুদ্রিক প্রযুক্তিবিষয়ক কোম্পানি কংসবার্গ। তাদের ২৪ শতাংশ আয়ের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রে মোট সম্পদের পরিমাণ মাত্র ৩ শতাংশ।
এর পরের অবস্থানে রয়েছে গ্ল্যানবিয়া, বেরি কেলিবট, নেসলে, থেলস, দিয়েগো, কম্পাস, অ্যাস্ট্রাজেনেকা, লিন্ডট অ্যান্ড স্প্রুয়েংলি, সভেনস্কা সেলুলোসা প্রভৃতি। এর মধ্যে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক খাদ্য, পানীয় ও তামাক পণ্য কোম্পানি নেসলের ৩৫ শতাংশ বিক্রির বিপরীতে স্থাবর সম্পদের পরিমাণ ২১ শতাংশ। এখন সম্পদ বাদ দিলে বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪ শতাংশ।
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন