ইউরোজোনের অর্থনীতি অনেক দিন ধরে খারাপ সময় পার করছে। বিপরীতে কভিড-পরবর্তী পুনরুদ্ধারে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া সুদহার কমাতে ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকের (ইসিবি) ওপর চাপ বেড়েছে।
ইউরোজোনের অর্থনীতি অনেক দিন ধরে খারাপ সময় পার করছে। বিপরীতে কভিড-পরবর্তী পুনরুদ্ধারে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া সুদহার কমাতে ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকের (ইসিবি) ওপর চাপ বেড়েছে। অর্থনীতির এমন বিপরীত অবস্থার প্রভাব পড়েছে অঞ্চল দুটির সরকারি বন্ডে বিনিয়োগে। অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন, এ নাজুক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোজোনের বন্ডের ইল্ডে (মুনাফা) বিদ্যমান ব্যবধান সামনে আরো প্রসারিত হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ১০ বছর মেয়াদি সরকারি বন্ডের ইল্ড গত জুলাইয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেড়েছে। অন্যদিকে জার্মানির একই মেয়াদের বন্ডের ইল্ড তেমন বাড়েনি। নিবিড় পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, জুলাইয়ের পর উভয় দেশের ১০ বছর মেয়াদি বন্ডের ইল্ডের পার্থক্য সবচেয়ে বেশি। এ পার্থক্য প্রায় ১৮৩ বেসিস পয়েন্টে পৌঁছেছে। সাধারণত স্থির হারে নির্ধারিত হওয়ায় বন্ডের দাম কমলে ইল্ড বাড়ে। বিপরীতে দাম বাড়লে ইল্ড কমে।
মার্কিন বহুজাতিক বিনিয়োগ সংস্থা ব্ল্যাকরকের ইউরোপিয়ান ফান্ডামেন্টাল ফিক্সড-ইনকাম ইনভেস্টমেন্ট বিভাগের সহপ্রধান সাইমন ব্লান্ডেল বলেন, ‘আমরা মনে করি, বাজারের এ গতিবিধি আরো কিছুদিন অব্যাহত থাকবে।’ তবে ইউরোপীয় বন্ডকে মার্কিন বন্ডের তুলনায় বেশি পছন্দ করেন বলে জানান ব্লান্ডেল।
গত মাসে ৫০ বেসিস পয়েন্ট সুদহার কমিয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ (ফেড)। চার বছর পর প্রথমবার এ পদক্ষেপ নেয় মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যবসায়ীরা এখন আশা করছেন, সুদহারের বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণে ফেড আরো সতর্ক হবে। এদিকে চলতি সপ্তাহে তৃতীয়বারের মতো সুদহার কমানোর পরিকল্পনা করছে ইসিবি। শেষবার জুনে সুদহার কমিয়েছিল তারা।
বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির বন্ডের ইল্ডের ব্যবধান ২০০ বেসিস পয়েন্টে উন্নীত হতে পারে। সর্বশেষ চলতি বছরের শুরুতে এ ধরনের পার্থক্য দেখা গিয়েছিল। আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সুদহারের তুলনায় ভালো পারফর্ম করবে ইউরোপীয় সুদহার। দুর্বল অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের কারণে ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্রুত পদক্ষেপ নিতে অনিচ্ছুক।
দুই অঞ্চলের ইল্ডের বেড়ে চলা ব্যবধান এরই মধ্যে অন্যান্য বাজারে প্রভাব ফেলছে। উচ্চ মুনাফার আশায় বিনিয়োগকারীরা এখন মার্কিন বন্ডের দিকে ঝুঁকছে। ফলে ইউরোর বিনিময় হার প্রায় দুই মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে নেমে গেছে। বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার বাড়ছে।
ইউরোপের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্প্রতি হতাশাজনক অবস্থায় পৌঁছেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অঞ্চলটির সবচেয়ে বড় অর্থনীতি জার্মানির অর্থ মন্ত্রণালয় গত সপ্তাহে জানিয়েছে, টানা দ্বিতীয় বছর দেশটির অর্থনীতি সংকুচিত হবে। দেশটির একসময়ের শক্তিশালী শিল্পোৎপাদন খাত জ্বালানি সংকটে ধুঁকছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এ সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে। এছাড়া চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাচ্ছে দেশটি।
লাজার্ড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের গ্লোবাল ফিক্সড-ইনকামের সহপ্রধান মাইকেল ওয়েডনার বলেন, ‘অর্থনীতির বাস্তব পরিস্থিতির পরিসংখ্যান কিংবা পূর্বাভাস, কোনোটাই আশাব্যঞ্জক নয়। সবকিছুই আরো খারাপ পরিস্থিতির আভাস দিচ্ছে।’
এদিকে ইউরোজোনের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি ফ্রান্স বাজেট ঘাটতি কমানোর অংশ হিসেবে কর বৃদ্ধি ও ব্যয় সংকোচনের ঘোষণা দিয়েছে। যাকে অনেক বিনিয়োগকারী ‘প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ’ হিসেবে দেখছেন। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি দেশটির প্রবৃদ্ধিকে চাপে ফেলবে।
আর্থিক সংস্থা ইউবিএসের ইউরোপীয় সুদহার কৌশল বিভাগের প্রধান রেইনউট ডি বক বলেন, ‘আগামী বছর প্রবৃদ্ধির হার না বাড়লে ইউরোজোনে সুদহার ১ শতাংশের নিচে নেমে যেতে পারে। ইউরোজোনের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার চীন। দেশটির অর্থনীতিতে মন্থরগতি তৈরি হয়েছে, যা ইউরোপের জন্যও উদ্বেগজনক।’
এদিকে সেপ্টেম্বরের কর্মসংস্থান প্রতিবেদন প্রকাশের পর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ে বাড়তি উদ্বেগ কমেছে। বিনিয়োগকারীরা নভেম্বরে ৫০ বেসিস পয়েন্ট সুদহার কমানোর বিষয়ে আশাবাদী হয়েছেন। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা (ওইসিডি) গত মাসে জানায়, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ২ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির দেখা পেতে পারে। আগামী বছর তা ১ দশমিক ৬ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। অন্যদিকে ইউরোজোনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চলতি বছর দশমিক ৭ ও আগামী বছর ১ দশমিক ৩ শতাংশ হতে পারে।
ইউরোজোনের ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, ইসিবি আগামী বছরের শেষ নাগাদ সুদহারে কাটছাঁট বন্ধ করবে এবং ২ শতাংশে স্থির রাখবে। প্রত্যাশিত এ হার কভিড মহামারীর আগে বিদ্যমান ঋণাত্মক সুদহারের তুলনায় অনেক বেশি। তবে ইউরোজোনের অর্থনীতি ২ শতাংশ সুদহার ধরে রাখতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন ব্যাংক অব আমেরিকার (বিওএফএ) বিশ্লেষকরা।
সব বিনিয়োগকারী ইউরোজোনের অর্থনীতি নিয়ে হতাশ নন। কারণ স্পেন ও ইতালির মতো দেশ সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। প্রিমিয়ার মিটন ইনভেস্টরসের ফিক্সড-ইনকাম বিভাগের প্রধান লয়েড হ্যারিস বলেন,”‘ইউরোপীয় অর্থনীতির পরিসংখ্যান মোটামুটি ভালো। প্রকৃতপক্ষে পূর্বাভাসের তুলনায় এটি উন্নতি করছে। বাজারে সুদহার কাটছাঁট বিষয়ে অতিরিক্ত প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। বাস্তবে এতটা নাও হতে পারে। ইউরোপের বন্ডের ইল্ড বাড়বে, যদিও তা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কম হবে।’
সূত্র : রয়টার্স।
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন