পাকিস্তানের লাহোরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা রাভি নদীর তীরেই ৪০ কিলোমিটারের বেশি এলাকাজুড়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নদীকেন্দ্রিক উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ উন্নয়ন প্রকল্প ভারত এবং পাকিস্তানের জন্য একটি ভালো সমঝোতার সুযোগ তৈরি করতে পারে।
পৃথিবীর জীবনধারার মূল ধমনিগুলো হলো নদ-নদী। এ নদীগুলো বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে পানি ও খনিজ পদার্থ সমৃদ্ধ উর্বর মাটি বয়ে নিয়ে আসে। আর এর মাধ্যমে মানব সভ্যতা বিকশিত হয়েছে। তাই পৃথিবীতে নদীকেন্দ্রিক অনেকগুলো প্রাচীন সভ্যতা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতাও গড়ে উঠেছিল বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধু নদ ও তার শাখা নদীর তীরকে কেন্দ্র করে। ভূ-রাজনীতিগত ভাবে এ অঞ্চল এখন পাকিস্তানের পূর্বাংশ ও ভারত সীমান্ত দ্বারা বিভক্ত।
এ সিন্ধু নদের উৎপত্তিস্থল ভারতে। কিন্তু নদীটির প্রধান অংশ এবং এর পাঁচটি শাখা নদী পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। জলসম্পদ নিয়ে সংঘাত এড়াতে ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংক ও যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি ভ্যালি কর্তৃপক্ষের সহায়তায় পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে একটি পানিবণ্টন চুক্তি সই হয়।
এ সিন্ধু ওয়াটার্স ট্রিটি অনুসারে পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর লাহোরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা রাভি নদীকে ভারতের অংশ হিসেবে বরাদ্দ দেওয়া হয়। রাভি নদীর একটি ঐতিহাসিক অতীত রয়েছে। এটি মুঘল সাম্রাজ্যের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। সেসব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার মধ্যে রয়েছে শালিমার উদ্যান। কিন্তু বর্তমানে ভারত বাধ দেওয়ায় শুকনো মৌসুমে খুব অল্প পরিমাণে পানি প্রবাহিত হয় এ রাভি নদী দিয়ে। কারণ ভারত অধিকাংশ পানি সংরক্ষণ করে রাখে। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় সেখানে এখন কৃষিকাজ হয় আর বর্ষাকালেও এর পানি প্রবাহ খুব একটা বাড়ে না, তুলনামূলক কমই থাকে।
তবে এই শুষ্ক নদীটি একটি বিশাল নদী কেন্দ্রিক উন্নয়ন প্রকল্পের অংশ হতে যাচ্ছে। এ প্রকল্পটি তীরের ৪০ কিলোমিটারের বেশি এলাকাজুড়ে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ উন্নয়ন প্রকল্পকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নদী কেন্দ্রিক প্রকল্প হিসেবে ধরা হচ্ছে।
নদীর সংকুচিত চ্যানেলগুলোর পাশ ঘিরে হাঁটাচলা, পার্কের মতো বিনোদনকেন্দ্র এবং আধুনিক আবাসিক ভবন তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বিশ্বের বেশ কয়েকজন রিয়েল-এস্টেটের বিনিয়োগকারীরা এ প্রকল্পে তাদের সমর্থন জানিয়েছে।
রাভি আরবান ডেভেলপমেন্ট কর্তৃপক্ষকে (আরইউডিএ) এই প্রকল্পের ৩টি ধাপে উন্নয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে পাকিস্তানের অনেক পরিবেশবাদীরা এ প্রকল্প নিয়ে সচেতন হতে শুরু করেছেন এবং এ প্রকল্প বাস্তবায়নে পরামর্শ ও মূল্যায়নের অভাব রয়েছে বলেও তারা অভিযোগ করেছে।
এ প্রকল্পের বিষয়ে ডেলাওয়্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশগত ব্যবস্থা বিভাগের গবেষক সালিম এইচ. আলি বলেন, “লাহোরে বেড়ে ওঠায় ব্যক্তিগত ও পেশাগতভাবে এ পরিবেশগত সংঘাতগুলো দ্রুত মীমাংসা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। সেপ্টেম্বরে আমরা প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে প্রথম নীতি সংলাপ আয়োজন করেছি।”
এর অংশ হিসেবে আমেরিকান ইনস্টিটিউট ফর পাকিস্তান স্টাডিজ এবং বিকনহাউস ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহায়তায় সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের একত্রিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সালিম এইচ. আলি। এ দলটি নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের পরিবেশগত স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যে একটি ভারসাম্য যাচাই করবে।
এ প্রকল্পটির লক্ষ্য ছিল অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও একইভাবে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায় কিনা তার পরীক্ষামূলক মডেল হিসেবে দাঁড় করানো। সংরক্ষিত করিডোরগুলোতে কিছু মতৈক্য হলেও রিয়েল-এস্টেট অবকাঠামোর ব্যাপকতা ও সুযোগ নিয়ে এখনও বড় মতপার্থক্য রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীর পানির প্রবাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং উজানের দেশ ভারতের ওপর বিশ্বাসের ঘাটতি এই সমস্যাগুলোকে আরও জটিল করে তুলেছে। রাভি নদীর উন্নয়ন সম্ভবত সিন্ধু ওয়াটার্স ট্রিটি পুনরায় আলোচনার জন্য একটি সুযোগ এনে দিতে পারে। গত মাসে ভারতও পাকিস্তানের কাছে এই চুক্তি পুনরায় আলোচনার জন্য অনুরোধ করেছে। কারণ তারা পাকিস্তানের নদীগুলো থেকে আরও পানি নিতে চায়।
রাভি নদী তীরবর্তী অঞ্চল তৃণমূল স্তর থেকে শুরু করে পরিবেশগত সক্রিয়তা, টেকসই তীরবর্তী উন্নয়নের অর্থনৈতিক প্রণোদনা এবং জলবায়ু সহনশীল চুক্তির জন্য ভূ-রাজনৈতিক চাপ সবক্ষেত্রেই ভারত এবং পাকিস্তানের জন্য একটি ভালো সমঝোতার সুযোগ তৈরি করতে পারে। (সূত্রঃ দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড)
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন