প্রাপ্য মজুরি ও ক্রমবর্ধমান স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি ব্যবহারের বিপরীতে সুরক্ষার দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূল ও গালফ কোস্টের বন্দরগুলোয় কর্মবিরতি শুরু করেছেন শ্রমিকরা। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় ১ অক্টোবর প্রথম প্রহরে শুরু হওয়া এ কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন উত্তর আমেরিকার শ্রমিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল লংশোরমেনস অ্যাসোসিয়েশনের (আইএলএ) প্রায় ৫০ হাজার সদস্য। এতে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি-রফতানি বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় শ্রমিক অসন্তোষের এ ঘটনায় মার্কিন অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সুনির্দিষ্ট কিছু দাবি নিয়ে মার্কিন বন্দর কর্তৃপক্ষ ইউনাইটেড স্টেটস মেরিটাইম অ্যালায়েন্সের (ইউএসএমএক্স) সঙ্গে দর কষাকষি করছে আইএলএ। তবে দুপক্ষের প্রস্তাবের মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান রয়েছে বলে মন্তব্য খাতসংশ্লিষ্টদের। এর মধ্যে ইউএসএমএক্স বিদেশী মালিকানাধীন শিপিং লাইন ও টার্মিনাল অপারেটরদের প্রতিনিধিত্বও করে।
ধর্মঘটের ফলে মেইন অঙ্গরাজ্য থেকে টেক্সাস পর্যন্ত প্রায় সব কার্গো বন্দরে পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে কলা থেকে শুরু করে ইউরোপীয় অ্যালকোহলনির্ভর পানীয়, আসবাবপত্র, পোশাক, গৃহস্থালির সামগ্রী ও গাড়ির সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কারখানাগুলো চালু রাখতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের জোগান হুমকির মুখে পড়তে পারে। এতে রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি বিক্রিতে প্রভাব পড়বে।
আইএলএর সভাপতি হ্যারল্ড ড্যাগেট বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরে বিদেশী মালিকানাধীন সমুদ্রবাহী জাহাজ কোম্পানিগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মুনাফা করে। অথচ মার্কিন শ্রমিকদের যথাযথ প্রাপ্য দিচ্ছে না। ফলে ধর্মঘটে যেতে বাধ্য হয়েছে তারা।’
গতকাল ধর্মঘট শুরুর ঘণ্টাখানেক পর এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আমরা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে প্রস্তুত। আইএলএ সদস্যদের প্রাপ্য মজুরি ও অটোমেশনের বিরুদ্ধে সুরক্ষা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে।’ তবে ধর্মঘটের বিষয়ে ইউএসএমএক্স কোনো বিবৃতি দেয়নি।
কভিড-১৯ মহামারীর পর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি নেমে এসেছে সম্প্রতি। তবে চলমান ধর্মঘট দীর্ঘ হলে দেশটিতে ভোক্তা ও শিল্পপণ্যের সংকট ও দাম বেড়ে যেতে পারে। এতে আবারো অর্থনৈতিক স্থবিরতা তৈরির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ধর্মঘট চলা নিউইয়র্ক অ্যান্ড নিউজার্সি পোর্ট পণ্য আমদানি-রফতানির দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম বন্দর। এছাড়া একাধিক বিশেষায়িত বন্দরেও ধর্মঘট চলছে। ডেলাওয়্যারের পোর্ট উইলমিংটনকে দেশটির প্রধান কলা আমদানিকারক বন্দর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমেরিকান ফার্ম ব্যুরোর মতে, ধর্মঘটের আওতাভুক্ত বন্দরগুলো দিয়ে বার্ষিক ১২ লাখ টন কলা আমদানি হয়, যা দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ কলার জোগান দেয়। ধর্মঘটের কারণে কোকো ও চিনিসহ খাদ্য কোম্পানিগুলোয় ব্যবহৃত কাঁচামালের একটি বড় অংশের জোগানও হুমকির মুখে পড়েছে। এছাড়া আসবাবপত্র ও যন্ত্রপাতির মতো পণ্যও এ ধর্মঘটের আওতাভুক্ত বন্দরগুলো দিয়ে আমদানি হয়।
১৯৭৭ সালের পর প্রথমবারের মতো পূর্ব উপকূলীয় এসব বন্দরে ধর্মঘট চলছে। আইএলএ বলছে, ইউএসএমএক্সের সঙ্গে চুক্তির আওতায় প্রায় ৫০ হাজার সদস্য কাজ করার কথা। তবে ইউএসএমএক্স জানিয়েছে, বন্দরগুলোয় প্রায় ২৫ হাজার কর্মসংস্থান আছে, যা সব কর্মীকে কাজ দেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। সমস্যা সমাধানের জন্য আইএলএর অবস্থান নমনীয় নয় বলে অভিযোগ সংগঠনটির। জুনের পর এ নিয়ে কোনো আলোচনায়ও অংশ নেয়নি তারা।
গত সোমবার ইউএসএমএক্স জানিয়েছে, তারা ছয় বছরের প্রস্তাবিত চুক্তির আওতায় মজুরি ৫০ শতাংশের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু আলোচনার সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন ব্যক্তি জানিয়েছেন, ইউনিয়ন এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। আইএলএ তাদের দাবির বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু জানায়নি। তবে গত সপ্তাহের শেষ নাগাদ বার্ষিক ৭৭ শতাংশ পর্যন্ত বেতন বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিল। এতে প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ মজুরি ৩৯ ডলার থেকে ৬৯ ডলারে উন্নীত হবে।
বন্দরের অটোমেশন পদ্ধতির ব্যবহার নিয়েও ইউনিয়ন ও কর্তৃপক্ষের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। ইউনিয়নের দাবি, এর ফলে তাদের কিছু সদস্যের চাকরি হুমকির মুখে পড়তে পারে। এক্ষেত্রে ইউএসএমএক্স অটোমেশনের ব্যবহারসংক্রান্ত একই চুক্তির শর্তাবলি বজায় রাখার প্রস্তাব দিয়েছে। এতে শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে বলেও দাবি তাদের।
ধর্মঘটের কারণে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন পণ্য পরিবহনের ওপর নির্ভরশীল মার্কিন ব্যবসায়ীরা। ধর্মঘট প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিতে গত সপ্তাহে জো বাইডেন প্রশাসনকে চিঠি পাঠিয়েছে দুই শতাধিক ব্যবসায়িক সংগঠন। ধর্মঘট বন্ধ করতে টাফ্ট-হার্টলে আইন প্রয়োগ করার পরামর্শ দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে ইউএস চেম্বার অব কমার্স। ১৯৪৭ সালে প্রণীত আইনটি সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ওয়েস্ট কোস্ট বন্দরে ইউনিয়ন সদস্যদের ১১ দিনের লকআউট বন্ধ করতে ব্যবহার করেছিলেন।
সূত্র : সিএনএন।
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন